পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারীকে হারিয়ে অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করছেন সাতক্ষীরার শ্যামনগরের যতিন্দ্রনগর গ্রামের হালিমা খাতুন।
২০০৬ সালে বন বিভাগ থেকে পাশ দিয়ে মধু সংগ্রহের জন্য যান তার স্বামী গোলাম গাজী। দু’দিন পরে খবর আসে গোলাপ গাজী বাঘের আক্রমণে নিহত হয়েছেন। এর কয়েকদিন পরে তার ছিন্ন-বিছিন্ন লাশ উদ্ধার করে নিয়ে আসে তার সঙ্গে যাওয়া অন্য মৌয়ালরা।
সেই থেকে হালিমা খাতুন তার ছেলে ও পুত্রবধূর সঙ্গে বাস করছেন। বর্তমানে পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী তার ছেলে।
স্বামীকে হারিয়ে ছেলে ও পুত্রবধূর সঙ্গে খুব কষ্টে দিনযাপন করছেন হালিমা খাতুন।
সুন্দরবনে গিয়ে বাঘের হাতে প্রাণ হারানো অপর ব্যক্তি শ্যামনগরের গাবুরা গ্রামের বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন।
মোশাররফের মা খালেদা বেগম ইউএনবিকে জানান, ২০১২ সালে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে নিহত হন মোশাররফ।
একই উপজেলার হরিনগর গ্রামের সুন্নত আলী শেখের স্ত্রী কোহিনূর বেগম জানান, ২০১৪ সালে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি তার স্বামী সুন্নত আলী শেখ।
তিনি জানান, পরে শুধু তিনি শুনেছেন, তার স্বামীকে বাঘে খেয়েছে। আর কোনো সন্ধান তিনি পাননি তার প্রিয় স্বামীর।
অন্যদিকে নিহত মৌয়াল শ্যামনগরের কাউসার গাইনের ভায়রা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, চলতি বছরের ২০মে বাঘের আক্রমণে মারা যান কাউসার।
একইভাবে ২০২১ সালে প্রাণ হারান হাবিবুর মোল্লা ও জিয়াউল ইসলাম নামের দুজন মৌয়াল।
গত এক দশকে ছয়জন মৌয়াল সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে নিহত হয়েছেন। এরা সকলেই সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বাসিন্দা।
নিহতদের কোন পরিবার আর চায়না তাদের পরিবারের কেউ আর সুন্দরবনের সঙ্গে জড়িত থাকুক।
আরও পড়ুন: সাতক্ষীরায় লোকালয়ে বাঘ, আতঙ্কে গ্রামবাসী
সুন্দরবন বাংলাদেশ তথা বিশ্বের একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন। দেশের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলা নিয়ে বিস্তৃত এ বন। সুন্দরবনের মোট আয়তন ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। যার মধ্যে বাংলাদেশে পড়েছে ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার, আর ভারতের পশ্চিম বাংলায় রয়েছে প্রায় ৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার।
পৃথিবী বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জন্য সুন্দরবন বিখ্যাত। এ ছাড়া হরিণ, বানর, কুমির সহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ও রয়েছে এ বনে।
সুন্দরবনের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বিভিন্ন নদীতে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার মাছ। আর রয়েছে মধু, এ বনের মধু পৃথিবী বিখ্যাত।
পর্যটকদের জন্য বরাবরই সুন্দরবন একটি আকর্ষণীয় জায়গা। আর পদ্মাসেতু হওয়ার পর পর্যটকদের কাছে সুন্দরবনের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
শুধু পর্যটন নয়, এই বনকে ঘিরে কয়েক লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। কেউ বনজীবী, জেলে বা মংস্য সংগ্রহকারী আবার কেউ মৌয়াল বা মধু সংগ্রহকারী।
এই সুন্দরবনকে ঘিরে অনেকে যেমন জীবিকা নির্বাহ করে তেমনি অনেকে সুন্দরবনে গিয়ে বাঘের শিকার হয়েছেন বা আক্রমণে মারা গেছেন। এদের অধিকাংশই ছিল মৌয়াল।
সম্প্রতি প্রথমবারের মতো খুলনায় মৌয়াল, চাষি, বণিক, গবেষক ও ভোক্তা জাতীয় জোটের উদ্যোগে বাঘের আক্রমণে নিহত মৌয়ালদের পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা দেয়া হয়। এসময় উপস্থিত ছিলেন খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক।
এসময় মেয়র বলেন, মৌয়াল, চাষি, গবেষক ও ভোক্তা জাতীয় জোট বাঘের আক্রমণে নিহতদের পরিবারকে অর্থিক সহায়তা করেছে।
তিনি বলেন, মৌয়াল, চাষি, গবেষক ও ভোক্তা জাতীয় জোটের এই সহযোগিতা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা ড. মো. মোহসীন হোসেন বলেন, মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে যারা নিহত হন, বন বিভাগ তাদের বিষয়ে সচেতন।
তিনি আরও বলেন, বন বিভাগ সবসময়ই তাদেরকে সহযোগিতা করে থাকে।
আরও পড়ুন: সুন্দরবন বাঘের আক্রমণে মৌয়াল নিহত