সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের সুভারকুটি গ্রামে ঘুরে দেখা গেল কৃষাণীদের কর্মযজ্ঞ। বন্যায় নষ্ট হয়ে যাওয়া ধান খেতে তাদের কেউ লাগিয়েছে শশা, কেউ সিম, কেউ কুল বড়ই ও পেঁপেসহ নানা সবজি।
সেপ্টেম্বরে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ২৫ শতক জমিতে শশা লাগিয়েছিলেন মেঘনা বেগম। তিন মাসে শশা বিক্রির যোগ্য হয়েছে। বুধবার দুই হাজার ৮০০ টাকার শশা বিক্রি করেছেন তিনি। সবজি চাষে তার খরচ হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এবার তিনি এক লাখ ২০ হাজার টাকার শশা বিক্রি করতে পারবেন। ফলে ৪০ হাজার টাকা আয় করতে পারবেন বলে আশা তার।
আরও পড়ুন: কুড়িগ্রামে বন্যায় ৪ হাজার হেক্টর জমির ফসল নিমজ্জিত
প্রতিবেশী আমিনা বেগম জানান, বন্যায় স্বামীর ভিটে-বাড়ি ভেঙে যাওয়ায় বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। ঋণ করে বাবার ৬০ শতক জমিতে আপেল কুল, পেঁপে, মরিচ ও বেগুন লাগিয়েছেন। এতে খরচ হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। স্বামীর ৩০ শতক জমিও বন্ধক রাখতে হয়েছে তাদের। এবার ধান চাষ করে অনেক টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে তাকে। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবার বিকল্প চাষবাস করে নিজের মাথা গোঁজার জন্য জমি কেনার স্বপ্ন দেখছেন এ কিষাণী।
জেলায় এ সংকটময় সময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বেসরকারি সংস্থা আরডিআরএস বাংলাদেশ। নারী কৃষাণীদের সহযোগিতায় তারা ১৩ হাজার নারীকে প্রশিক্ষণসহ দুই হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত কৃষি পুনর্বাসনের অর্থ সহযোগিতা দিয়েছে। এর সাথে অন্যান্য ঋণ নিয়ে ভাগ্য বদলাতে চাইছেন অনেক নারী।
আরও পড়ুন: কুড়িগ্রামে বন্যার ক্ষতি পোষাতে আগাম সবজি চাষ
হলোখানা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য গোলজার হোসেন বলেন, ‘দিনকাল বদলে গেছে। বাড়ির বউ-ঝিরা এখন শুধু ঘরের কাজ নয়; স্বামীর সাথে কৃষি কাজেও হাত লাগাচ্ছেন। আবাদ কীভাবে করতে হয় তা জেনেছেন তারা। ফলে এখন পুরুষরা জমি তৈরি করে দিয়ে অন্য জেলায় চলে যান কাজের আশায়। আর বউ-ঝিরা কোমড় বেঁধে লেগে পড়েন আবাদে।’
একই গ্রামের ইতি বেগম জানান, এ এলাকায় কখনও বন্যা হতো না। কিন্তু গত ২০১৭ সাল থেকে বন্যা হচ্ছে। এবার পাঁচ দফা বন্যায় তিনবার বীজতলা ও ধান খেত বিনষ্ট হয়েছে। এতে তার লোকসান হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার টাকা। আরডিআরএস থেকে পুনর্বাসনের জন্য তিনি প্রায় ১২ হাজার টাকা পেয়েছেন। তার সাথে নিজের কিছু অর্থ দিয়ে ৩০ শতক জমিতে সিম লাগিয়েছেন। সিম বিক্রি করে লোকসান পূরণ করতে চাইছেন এ কৃষাণী।
আরও পড়ুন: কুড়িগ্রামে বন্যার পানির বালুতে ঢেকে গেছে আবাদি জমি, সংকটে কৃষকরা
সদরের সুভারকুটি গ্রামের পাশাপাশি বন্যাকবলিত পাঁচগাছী, যাত্রাপুর ও উলিপুর উপজেলার বজরা এবং বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের কৃষাণীরাও এখন বিকল্প চাষাবাদ করে ভাগ্য বদলানোর স্বপ্ন দেখছেন।
আরডিআরএস কৃষির পাশাপাশি অন্যান্য কাজেও নারীদের সাহায্য করছে। বজরা ইউনিয়নের খামার বজরা মুন্সিপাড়া গ্রামের প্রতিবন্ধী হাসিনা বেগমের মুখে হাসি ফুটেছে একটি সেলাই মেশিন কিনে। বিভিন্নভাবে প্রকল্প থেকে প্রায় ২২ হাজার টাকা পেয়ে সেলাই মেশিন কিনেছেন তিনি। তা দিয়েই ভাগ্য বদলাতে চেষ্টা করছেন।
আরও পড়ুন: কুড়িগ্রামে বন্যার পানি কমার সাথে ছড়িয়ে পড়ছে নানা রোগ-বালাই
পার্শ্ববর্তী কালপানি বজরা ব্যাপারী পাড়া গ্রামের শিউলী বেগম ২০১৮ সালে পুনর্বাসনের জন্য পান ১১ হাজার ৬০০ টাকা। তার সাথে নিজের কিছু অর্থ যোগ করে একটি বাছুর কিনেছিল। এখন তার ঘরে তিনটি গরু ও একটি বাছুর রয়েছে। গাভিটি দুধ দিচ্ছে। তা বিক্রি করে পরিবারে সহযোগিতা করছেন তিনি।
আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও উন্নতিকরণের মাধ্যমে নারী ও যুবাদের ক্ষমতায়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা আরডিআরএসের প্রকল্প সমন্বয়কারী তপন কুমার সাহা জানান, কুড়িগ্রাম সদরের পাঁচগাছী, যাত্রাপুর ও উলিপুর উপজেলার বজরা এবং বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে ১৩ হাজার নারী ও যুবাদের আর্থিক উন্নয়নের পাশাপাশি ক্ষমতায়নে কাজ করা হচ্ছে। এতে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করছে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ট্রিকেলাপ ও মেডলাইট ফাউন্ডেশন। এতে কারিগরি সহযোগিতা করছে কনসার্ন ওয়াল্ড ওয়াইড।
আরও পড়ুন: কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও বানভাসিদের দুর্ভোগ কমেনি
হলোখানা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উমর ফারুক বলেন, ‘সমাজে বেকার বসে থাকা নারী ও যুবাদের এ কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার ফলে তারা নিজেদের উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক বিভিন্ন সচেতনতামূলক কাজে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। কিছু নারী ও যুবা এ কর্মকাণণ্ডের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য বদলে সফলতা দেখিয়েছে।’