বিভিন্ন কারণে সুন্দরবনে বাঘের অবাধ বিচরণ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় নিজেদের মধ্যে আন্তঃপ্রজনন হওয়ায় বাঘ রোগাক্রান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় আন্তঃপ্রজনন রোধ করতে সুন্দরবনের মধ্যে বাঘ স্থানান্তর করতে চায় বন বিভাগ।
এ বিষয়ে প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী জানান, সুন্দরবনের মধ্যে শিপশা, পশুর ও পাঙ্গাশিয়াসহ বড় বড় নদীর কারণে বাঘ আলাদা হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে সুন্দরবনের কিছু অংশে বাঘের ভ্যারাইটি কমে গেছে। ফলে নিজেদের মধ্যে বাঘের আন্তঃপ্রজনন হচ্ছে। আন্তঃপ্রজননের কারণে বাঘ নানা ভাবে দুর্বল এবং রোগাক্রান্ত হচ্ছে। সুন্দরবনের একস্থান থেকে নিয়ে অন্য স্থানে বাঘ স্থানান্তর করা গেলে প্রজননের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসবে বলে তিনি মনে করেন।
‘বাঘ আমাদের অহংকার, রক্ষার দায়িত্ব সবার’- এই প্রতিপাদ্য নিয়ে শুক্রবার (২৯ জুলাই) বাগেরহাটে সুন্দরবনের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জ এলাকায় আলাদা ভাবে বিশ্ব বাঘ দিবস পালিত হয়।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, শতবছরে বিশ্বের বনাঞ্চল থেকে বাঘের সংখ্যা এক লাখ থেকে কমে মাত্র চার হাজারের নিচে দাঁড়িয়েছে। বাঘের আটটি উপ-প্রজাতির তিনটি এরইমধ্যে বিশ্ব থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পাঁচ বছর আগেও বিশ্বের মাত্র ১৩টি দেশে বাঘ ছিল। সেখান থেকে আরও একটি দেশ বাঘ হারিয়েছে। এখন বাংলাদেশসহ মাত্র ১২টি দেশে বাঘের অস্তিত্ব রয়েছে। সারা বিশ্বের বন উজাড়, চোরশিকারি ও পাচারকারিদের কারণে বাঘ মহাবিপন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বর্তমানে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের আনাগোনা দেখা গেছে। পর্যটক এবং বন বিভাগের সদস্যদের নজরে পড়ছে বাঘ ও তার বাচ্চা। এ অবস্থায় সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগার বিচরণের খবর আশার আলো জাগিয়েছে।
বন বিভাগের তথ্যমতে, বাঘের আটটি উপ-প্রজাতির মধ্যে ইতোমধ্যে বালিনীজ টাইগার, জাভানীজ টাইগার ও কাম্পিয়ান টাইগার বিশ্ব হতে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে পাঁচটি উপ-প্রজাতি কোন রকম টিকে আছে। সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকার ও আন্তর্জাতিক স্বাক্ষরিত প্রটোকল অনুসারে সুন্দরবনে বাঘ রক্ষার জন্য বন বিভাগ কাজ করছে। ২০১৮ সাল থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে টাইগার অ্যাকশান প্লান নামে ১০ বছর মেয়াদি প্লানের আওতায় বাঘ রক্ষায় কাজ চলছে।
জানা গেছে, দেশে বাঘের একমাত্র আবাসস্থল সুন্দরবন। চোরাশিকারীচক্র ও জলদস্যু-বনদস্যুদের তৎপরতার কারণে কয়েক বছর আগেও সুন্দরবনে অনেকটা হুমকির মুখে ছিল বাঘ। দস্যুরা আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসায়, বিগত কয়েক বছর ধরে সুন্দরবনে দস্যুতা প্রায় শুন্যের কোঠায়। এছাড়া চোরাশিকারিদের তৎপরতাও কমে এসেছে। একারণে সুন্দরবনে বাঘ অনেকটা সুরক্ষিত এবং বাঘের বিচারণ ক্ষেত্র নিরাপদ বলে মনে করছে বন বিভাগ।
আরও পড়ুন: সুন্দরবনে বাঘের পাশাপাশি গণনা করা হবে হরিণ ও শূকর
বন বিভাগ জানায়, ২০১৩-২০১৫ সালে সুন্দরবনে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে প্রথম জরিপ করে বাঘ পাওয়া গেছে ১০৬টি। দ্বিতীয় বার ২০১৭-২০১৮ একই পদ্দতিতে জরিপ করে সুন্দরবনে বাংলাদেশ অংশে বাঘের ১১৪টি সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়।
জানা গেছে, সুন্দরবনের মোট আয়াতন ছয় হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে স্থলভাগের পরিমাণ চার হাজার ১৪৩ বর্গ কিলোমিটার। বর্তমানে সুন্দরবনের মোট আয়াতনের অর্ধেকেরও বেশি এলাকা সংরক্ষিত বনাঞ্চল। আর গোটা সুন্দরবন জুড়েই রয়েল বেঙ্গল টাইগার কম বেশি বিচরণ করে থাকে।
বন বিভাগের তথ্যমতে, ২০০১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে নানা ভাবে প্রায় অর্ধশত বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগে ২২ টি এবং পশ্চিম বিভাগে ১৬টি বাঘের মৃত্যু হয়। এছাড়া ওই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন এলাকা থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর সদস্যরা ১১টি বাঘের চামড়া এবং বাঘের অঙ্গপ্রতঙ্গ উদ্ধার করে।
বাগেরহাটের শরণখোলা ও মোংলা উপজেলার দেলোয়ার হোসেন, জামাল হোসেন, ইউসুফ আকনসহ কয়েকজন জেলের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, সম্প্রতি তারা সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় নদী-খালের চড়ে বাঘের পায়ের ছাপ দেখেছে। মাঝে মধ্যে তাদের কানে বাঘের ডাক ভেসে আসে।
বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী আরও জানান, চোরাশিকারী, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে সুন্দরবনে বাঘ হুমকির মুখে রয়েছে। বাঘের আবাস্থল নিরাপদ রাখতে বন বিভাগ কাজ করছে।
বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরীর তথ্যমতে, ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরের পর সুন্দরবনে আর বাঘ গণনা হয়নি। সম্প্রতি সুন্দরবন ‘বাঘ সংরক্ষণ’ নামে একটি প্রকল্পের অনুমোদন হলেও এখন পর্যন্ত অর্থবরাদ্ধ পাওয়া যায়নি। অর্থবরাদ্ধ পাওয়া গেলে চলতি বছরের শীত মৌসুমে সুন্দরবনে বাঘ গণনার কাজ শুরু করা হবে। নতুন করে বাঘ গণনা হলে জানা যাবে সুন্দরবনে বাঘের সঠিক সংখ্যা।
বন্যপ্রাণি ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো জানান, গবেষণায় দেখা গেছে, সুন্দরবনে বাঘের ধারণক্ষমতা ২০০টি। বাঘের বর্তমান সংখ্যা থেকে ২০০টিতে উন্নীত করতে বন বিভাগ নানা উদ্যোগ নিয়ে বাস্তবায়ন করছে। বাঘসহ সব ধরণের বন্যপ্রাণির প্রজনন নির্বিঘ্নে করতে জুন, জুলাই ও আগস্ট-এই তিন মাস সুন্দরবনে পর্যটক ও জেলেসহ সব ধরণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, সর্বশেষ জরিপ অনুসারে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১১৪টি। তবে সম্প্রতি সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে পর্যটক ও বনের স্টাফরা ছোট বড় বিভিন্ন সাইজের বাঘ দেখেছে। একই সাথে বনের বিভিন্ন এলাকায় বাঘের পায়ের চিহ্ন দেখা গেছে; এতে করে মনে হচ্ছে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ডিএফও মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন আরও জানান, বাঘ শিকারিদের তৎপরতা রুখে দিতে নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি স্মার্ট পেট্রোল চলছে সুন্দরবনে। বন বিভাগের পাশাপাশি সিএমসি, সিপিজি ও বিটিআরসি নিয়মিত সুন্দরবন বাউন্ডারি এলাকায় নিয়মিত টহল দেয়।
বিশ্ব বাঘ দিবস উপলক্ষ্যে বাগেরহাটে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জ ও শরণখোলা রেঞ্জ এলাকায় পৃথক র্যালি ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। চাঁদপাই রেঞ্জে বাঘ দিবসের আলোচনায় সভায় সভাপতিত্ব করেন সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের ডিএফও মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন। প্রধান অতিথি ছিলেন বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নির্মল কুমার পাল।
আরও পড়ুন: সুন্দরবনে ২১ বছরে ৪০ বাঘের মৃত্যু
বাঘ সংরক্ষণে সুন্দরবনে মানুষের প্রবেশ বন্ধ করতে হবে: পরিবেশ উপমন্ত্রী