বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারের হতাশা ভুলে ভালো সময়ে ফেরার অপেক্ষা করছে।
কোভিড-১৯ মহামারি এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া শেয়ারবাজারের অবস্থা পুনরুদ্ধার, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন কার তত্ত্বাবধান করা উচিত তা নিয়ে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ফ্লোর প্রাইস (ন্যূনতম বিক্রয় হার) এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক পতনের উপর আটকে আছে।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, পুঁজিবাজারের অনেক হতভাগ্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর জন্য এটি বেদনাদায়ক।
নীতিনির্ধারকরা এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সতর্কতা জানিয়ে বলেছে, নতুন কোম্পানির তালিকাভুক্তি এবং বড় বিনিয়োগের মাধ্যমে স্টক মার্কেট পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। কিন্তু ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের অবস্থা আশাহীন বলেই মনে হচ্ছে।
বিপুল সংখ্যক শেয়ারহোল্ডার এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পুঁজিবাজারে তাদের বিনিয়োগে আটকে রয়েছেন।
আব্দুল লতিফ নামে এক মুদি দোকানের মালিক এবং ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারী ইউএনবিকে বলেন, ‘কেউ, এমনকি নিয়ন্ত্রক বা স্টক মার্কেট কর্তৃপক্ষও তাদের ডাকে সাড়া দেয় না।’
তিনি জানান, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার কিনতে ২০১১ সালে তিনি ১৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন।
১৯৯৮ সালে স্নাতক শেষ করার পর লতিফ কোনো উপযুক্ত চাকরি খুঁজে পান না। তারপর ২০০২ সালে তার শ্বশুরের সহায়তায় মতঝিল এলাকায় একটি ছোট ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসায় ভালো লাভ করেন এবং শেয়ার বাজারে টাকা বিনিয়োগ করেন।
আরও পড়ুন: বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত থাকা সত্ত্বেও মেয়াদ বাড়ছে ব্যয়বহুল ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের
২০১০ সালে লতিফ প্রায় ১৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন, যার মধ্যে ৫ লাখ তার নিজের এবং ৮ লাখ আত্মীয়দের কাছ থেকে ধার করেছিলেন।
২০১১ সালে পুঁজিবাজারে বড় ধরনের কেলেঙ্কারির কারণে তার সব বিনিয়োগ বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারে আটকে যায়।
২০১১ সালে লতিফের মতো হাজার হাজার বিনিয়োগকারী তাদের কষ্টার্জিত মূলধন হারিয়েছিল এবং এরপরে কেউ কেউ মূলধন ফিরে পেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের অধিকাংশই প্রায় সব বিনিয়োগ হারিয়ে পুঁজিবাজার ছেড়ে যান।
এরকম আরও অনেক বিনিয়োগকারী এখনও ডিএসইতে ফেরার আশায় রয়েছেন, কিন্তু কোনো আশা পাচ্ছেন না তারা।
আগামী নির্বাচনের আগে ফ্লোর প্রাইস উঠার কোনো লক্ষণ নেই।
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজারের ওপর মানুষের আস্থা নেই। আগামী জানুয়ারির মধ্যে সাধারণ নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধরতে পরামর্শ দিয়েছে বিএসইসি।
অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবিএম মির্জা আজিজুল ইসলাম ইউএনবিকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এরসঙ্গে যোগ হয়েছে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংকট, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং নির্বাচন ও জাতীয় রাজনীতিসহ সবকিছু।’
ফলে সবার আগে আস্থার সংকট দূর করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
এ ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আস্থা নিশ্চিত করতে হবে বলে জানান তিনি।
অর্থাৎ, বিনিয়োগকারীদের আশ্বাস দিতে হবে যে কেউ যদি কারসাজির মাধ্যমে তাদের টাকা চুরি করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এছাড়া, ভালো শেয়ারের সরবরাহ বাড়াতে হবে। এই দুই কাজের মাধ্যমে বাজার সমস্যা দূর করা সম্ভব।
তবে এটা মোটেও সহজ নয় বলে জানান ড. আজিজুল ইসলাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ বলেন, বাজারে দুটি সংকট রয়েছে: একটি চাহিদার ক্ষেত্রে এবং অন্যটি বিনিয়োগকারীদের আস্থায়।
আরও পড়ুন: ২০২৫-২৬ অর্থবছরের মধ্যে জিডিপির ১১.২% কর আদায়ের লক্ষ্য সরকারের
তিনি বলেন, সরবরাহের দিক থেকে সমস্যা হলো ভালো কোম্পানি কম আছে। ফলে এটা কারসাজি ও সিন্ডিকেটের জন্য উইন-উইন পরিস্থিতি।
সব মিলিয়ে শেয়ারবাজার বর্তমানে একটি অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে রয়েছে এবং ধীরে ধীরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। এখান থেকে অবস্থা পরিবর্তন খুবই কঠিন বলে জানান তিনি।
বাজার সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শেয়ারবাজারের অবস্থা ভয়াবহ। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।
সরকারের কাছেও বাজার তার গুরুত্ব হারিয়েছে। যারা সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সরাসরি জড়িত নন, তাদের জন্য শেয়ারবাজার বিরক্তির কারণ।
তাদের ভাবনাটা এরকম, শেয়ারবাজার না থাকলে দেশে কোনো সমস্যা থাকবে না। এসব কারণে আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত ফ্লোর প্রাইস দিয়ে বাজার ধরে রাখতে চায় সরকার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাজারের ভেতরের লোকজন জানিয়েছেন,এটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার আশীর্বাদপুষ্ট সিন্ডিকেটের জন্য বাজার নিয়ন্ত্রণ করার একটি সুযোগ করে দেয়।
বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম এ প্রসঙ্গে ইউএনবিকে বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে নেই। বিনিয়োগকারীদের গুজবের উপর নির্ভর করে যেকোনো কোম্পানির সঙ্গে বিনিয়োগ থেকে সাবধান হওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, অর্থনৈতিক জ্ঞানের অভাবে মানুষ অনেক সময় বড় লাভের আশায় দুর্বল শেয়ারে বিনিয়োগ করছে, যা বিনিয়োগের সঠিক উপায় নয়।
আরও পড়ুন: বেসরকারি খাতের উৎপাদকদের ক্রমবর্ধমান অর্থ বকেয়া বিদ্যুৎখাতের অন্যতম বাধা