এক যুগ আগেও তিনি ফেরি করে পলিথিন বিক্রি করতেন। মাঝে কিছু দিন বিক্রি করেছেন ঝালমুড়ি। সব ছেড়ে দিয়ে মাইক্রোবাসে হেলপারির চাকরি নেন। কিন্তু এর এক যুগ পর এসে সেই তবারক এখন বনে গেছেন কোটিপতি। তার নিয়ন্ত্রণে নারী-পুরুষের সম্বন্বয়ে গঠিত মাদকের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে বলেও জানা গেছে।
অর্থবিত্তের মালিক হওয়ায় এলাকায় দানবীর খেতাবও পেয়েছেন তবারক। এর ফলে এলাকায় তার প্রভাবও বেড়েছে স্থানীয়দের চেয়ে কয়েকগুণ। সেই প্রভাব খাটিয়ে সরকারি সড়কের পার্শ্বের গাছ কেটে ভবনও নির্মাণ করেছেন তিনি। বিভিন্ন ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় থাকায় তবারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করারও সাহস পাচ্ছেন না এলাকাবাসী।
দীর্ঘদিন ধরে নিজের প্রভাব খাটিয়ে তবারক আলী ওরফে ইয়াবা সুমন ও তার স্ত্রী ইয়াবা ব্যবসায়ী সাবিনা আক্তার লোকচক্ষুর অন্তরালে নিজেদের অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন। কিন্তু গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাত দেড়টার দিকে সিলেট থেকে ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের একটি বাস থেকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এসআই আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে হবিগঞ্জ ডিবি পুলিশের একটি দল ১ কোটি ৮১ লাখ টাকা মূল্যের ৬১ হাজার পিস ইয়াবাসহ নাহিদা বেগম ও শাহিনা খাতুন নামের দুজন নারী মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে।
ওই দুই নারী ছিলেন তবারক-সাবিনার সিন্ডিকেটের অন্যতম প্রধান সদস্য। গ্রেপ্তারের পর ডিবি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তবারক আলী ও তার স্ত্রীর হয়ে কাজ করার কথা জানান তারা।
এ ঘটনায় হবিগঞ্জ ডিবি পুলিশের এসআই আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে তবারক-সাবিনাসহ গ্রেপ্তারকৃতদের অভিযুক্ত করে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ৬ (তাং ০৬.০২.২০২০ইং)।
জানা যায়, বর্তমানে তবারকে আলীর (নিজের বা আত্মীয়-স্বজনদের নামে) সম্পদের তালিকায় প্রায় ৫০ একর ভূমি, ১০-১২টি গাড়ি, ঢাকা-গাজীপুর সড়কে চলাচলকারী ৩টি বাস, ২টি ট্রাক, ১৬টি সিএনজি অটোরিক্সাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ টাকা রয়েছে।
এছাড়া, বিশ্বনাথ উপজেলা সদরের পুরাণ বাজারের শরিষপুর গ্রামে তবারকের একটি ৫তলা বিশিষ্ট ভবন ও রামপাশা ইউনিয়নের পাঠাকইন গ্রামে ডুপ্লেক্স বিল্ডিং নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে।
ঝালমুড়ি বিক্রেতা থেকে গাড়ির চালক হওয়ার পরই অপরাধ জগতে পা রাখেন তবারক। শুরু করে গাড়ি চুরি। এর কিছুদিনের মধ্যেই আন্তবিভাগীয় গাড়ি চোর দলের একজন সক্রিয় সদস্য হয়ে উঠেন তিনি।
২০১০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সিলেট বিভাগের বিভিন্ন থানায় তবারকের বিরুদ্ধে চুরি-ছিনতাইয়ের অভিযোগে ৭টি মামলা ও ২টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) দায়েরের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব মামলায় একাধিকবার গ্রেপ্তারও হয়েছেন তবারক।
২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর বিশ্বনাথ থানা পুলিশ তবারককে দুই দিনের রিমান্ডে নিলেও, পরদিন বিকাল ৩টার দিকে হাতকড়াসহ থানা হাজত থেকে পালিয়ে যান তিনি। এঘটনায় সেসময় থানা পুলিশের দুই সদস্যকে ক্লোজ করা হয়েছিল।
জানা যায়, ২০১৬ সালে গ্রেপ্তারের পর জেলহাজতে একজন কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ীর সাথে তবারকের সম্পর্ক গড়ে উঠে। পরে জামিনে জেল থেকে বেরিয়ে এসে ইয়াবা বিক্রির সাথে জড়ান তবারক আলী। আর এখন তিনি তার নিজস্ব মেশিন দিয়ে ইয়াবা তৈরি করার পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন নিজের শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট। আর মাদকের জগতে নিজের নাম বদলে পরিচিত হয়ে উঠেছে ইয়াবা সুমন হিসেবে।
২০১৯ সালে তবারক আলী ওরফে ইয়াবা সুমনের বিরুদ্ধে বিশ্বনাথ থানায় আরও দুটি মামলা এবং দুটি জিডি দায়ের করা হয়। গত ২৬ আগস্ট ৩৬ (১) এর ১৯ (ক) মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ অনুযায়ী বিশ্বনাথ থানার এসআই দেবাশীষ শর্ম্মা বাদী হয়ে তবারকসহ তিনজনকে অভিযুক্ত করে একটি মামলা (নং ২৪, তাং ২৬.০৮.২০১৯ইং) দায়ের করেন।
এরপর বিশ্বনাথ-লামাকাজী সড়কের আমজদ উল্লাহ কলেজের সামন থেকে আধা কেজি গাঁজাসহ তবারকের স্ত্রী সাবিনা বেগমের মালিকানাধীন সিএনজি চালিত অটোরিক্সা (সুনামগঞ্জ-থ ১১-২০৬৭) জব্দ করে পুলিশ। আর গত ২৪ অক্টোবর তবারক আলী ওরফে ইয়াবা সুমনকে অভিযুক্ত করে ওই মামলায় আদালতে চার্জশিট প্রদান করে পুলিশ।
একই বছরের ১৬ অক্টোবর সরকারের বিভিন্ন দপ্তর বরাবর তদন্ত সাপেক্ষে তবারক আলী ওরফে ইয়াবা সুমনকে আইনের আওতায় আনার দাবিতে রামপাশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ এলাকায় প্রায় তিন শতাধিক ব্যক্তি স্বাক্ষরিত স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। এর একদির পরই স্বারকলিপিতে স্বাক্ষর দেয়ায় পাঠাকইন গ্রামের চুনু মিয়ার ওপর হামলা চালায় তার (তবারক) পক্ষের লোকজন। এ ঘটনায় চুনু মিয়া বাদী হয়ে তবারকসহ সাতজনকে অভিযুক্ত করে একটি মামলা (নং ১১, তাং ১৮.১০.২০১৯ইং) দায়ের করেন।
এছাড়া চুরি-ছিনতাইয়ের অভিযোগে তবারকের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলো হলো- সিলেটের বিশ্বনাথ থানার এফআইআর নং ২ (তাং ১.০৪.২০১০ইং), ২৩ (তাং ২৯.০৯.২০১০ইং), ১৯ (তাং ২৫.০৮.২০১১ইং), ২৫ (তাং ২৫.১১.২০১০ইং), ৩ (তাং ৩.১১.২০১২ইং), ১৩ (তাং ২৮.০২.২০১৫ইং), জিডি নং ৫৮ (তাং ২.১২.২০১৪ইং), ৯৯৫ (তাং ২৮.০৯.২০১০ইং) এবং সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর থানার এফআইআর নং ৭ (তাং ১০.১২.২০১৪ইং)।
বিশ্বনাথ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামীম মুসা জানান, শুধু তবারক নয়, মাদক ব্যবসার সাথে যে বা যারাই জড়িত থাকবে, তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।
‘ইতোমধ্যে তবারক-সাবিনাসহ গ্রেপ্তারকৃতদের অভিযুক্ত করে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং সাবিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে,’ বলেন তিনি।
এছাড়া সরকারি গাছ কেটে থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে তবারকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্বনাথ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম নুনু মিয়া।