কীভাবে আমরা তার সন্তানদের বলব যে তাদের বাবা মারা গেছেন- প্রশ্ন ডা. মঈনের ছোট বোন সাবিরা খাতুনের।
ইউএনবির সাথে মোবাইলে আলাপকালে তিনি বলেন, ডা. মঈনের সদ্য বিধবা স্ত্রী ও সিলেটের পার্কভিউ মেডিকেল কলেজের ফিজিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. চৌধুরী রিফাত জাহান তাদের দুই ছেলেকে বলেছেন যে তাদের বাবা ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসা শেষ হলেই তাদের সাথে দেখা হবে।
সিলেটের সুজাতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা সাবিরা বলেন, ডা. মঈনের দুই ছেলে যিয়াদ (১১) এবং যায়ান (৭) তাদের বাবাকে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে। তাদের মা তাদের বাবার মৃত্যুর মতো কঠিন সংবাদের পরেও নিজের মনোবল ধরে রাখার সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। একদিন হয়তো তার সন্তানেরা এ কঠিন সত্যটি জেনে যাবে। তখন তাদের ওপর নেমে আসা সে ঝড়ে মানসিকভাবে মনোবল শক্ত রাখতে হবে।
সাবিরা এবং তার স্বামী সুনামগঞ্জের প্রাইমারি টিচারস ট্রেনিং ইন্সটিটিউটের প্রশিক্ষক এম খসরুজ্জামান ইউএনবির সাথে কথা বলার সময় মানুষকে সেবা দিতে গিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া ডা. মঈনকে নিয়ে তাদের গর্বের কথাও বলেন। সেই সাথে তার জীবনের আরও অনেক অজানা বিষয় তুলে ধরেন তারা।
কীভাবে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন ডা. মঈন
খসরুজ্জামান বলেন, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ডেপুটেশনে শহীদ সামসুদ্দীন আহমেদ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে পাঠানো হয়েছিল ডা. মঈনকে। সেখানে ২৮ মার্চ পর্যন্ত তিনি মরণঘাতী করোনাসহ বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ নিয়ে সেবা নিতে আসা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। এসব রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে শুধুমাত্র একটি মাস্ক ছাড়া তার আর অন্য কোনো ধরনের সুরক্ষা সামগ্রী ছিল না।
তিনি ২৯ মার্চ অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেন এবং তারপরে সিলেটের হাউজিং এস্টেট এলাকায় নিজের বাড়িতে সেলফ-কোয়ারেন্টাইন শুরু করেন। কারণ তিনি সন্দেহ করেছিলেন যে কোনো রোগীর কাছ থেকে তার করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। ৩০ মার্চ থেকে তার জ্বর আসে এবং পরে অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তিন দিন পরে, তার মধ্যে জ্বর, কাশি, হাঁচি এবং গলাব্যথার মতো করোনাভাইরাসের আরও কিছু লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে, খসরু বলে যান।
ডা. মঈন তার অবস্থা সম্পর্কে সহকর্মীদের অবহিত করার পরে ৪ এপ্রিল তার নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ঢাকার ল্যাবে পাঠানো হয়। পরের দিন পাওয়া প্রতিবেদনে তিনি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা যায়।
খসরু বলেন, কয়েক দিন পরে ডা. মঈনের শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা এবং প্রেশার কমে গিয়ে অবস্থার অবনতি হলে তাকে ৭ এপ্রিল রাতে শহীদ শামসুদ্দিন আহমেদ হাসপাতালের করোনা ইউনিটের আইসিইউতে নেয়া হয়।
তবে শামসুদ্দীন আহমেদ হাসপাতালে ভেন্টিলেটর চালানোর জন্য বিশেষজ্ঞ না থাকায় তাকে ওসমানী মেডিকেলের আইসিইউতে বা ঢাকার কোনো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার স্ত্রী ডা. রিফাত ওসমানী হাসপাতাল এবং স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন।
ডা. মঈনকে ওসমানীর আইসিইউতে স্থানান্তর বা এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে না পেরে অবশেষে ডা. রিফাত ও খসরু একটি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে সিলেট থেকে ডা. মঈনের সাথে ৮ এপ্রিল বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন।
ওই দিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে ডা. মঈনকে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছিল এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে তার সহপাঠী, সহকর্মী এমনকি তার সাবেক শিক্ষার্থীরাও তার দেখাশোনা করছিলেন। অক্সিজেন দেয়ার পরে ও ভালোমানের সেবা পাওয়ার পর তার অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল। তিনি ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত খাবার খেতে পারছিলেন এবং সাধারণভাবে সবার সাথে কথা বলতে পারছিলেন, বলেন খসরু।
তিনি বলেন, তবে ১৪ এপ্রিল ডা. মঈনের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে এবং তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। ‘অবশেষে, আমরা ১৫ এপ্রিল সকালে চূড়ান্ত খারাপ খবরটা পেয়েছি। ভাবি তার স্বামীর কাছাকাছি যেতে না পারলেও কুর্মিটোলা হাসপাতালেই ছিলেন। ওই দিনই তিনি সিলেটে ফিরে আসেন এবং বেদনা ও যন্ত্রণা লুকিয়ে রেখে বাচ্চাদের দেখাশোনা করছেন।
ডা. মঈনের অসম্পূর্ণ স্বপ্ন
সাবিরা জানান, তার ভাইয়ের স্বপ্ন ছিল সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার নাদামপুরে তার নিজের গ্রামের লোকদের সেবা এবং তাদের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে একটি হাসপাতাল স্থাপন করা।
তিনি বলেন, ‘আমার ভাই সবসময় বলতেন চিকিৎসক হিসেবে তার জীবন সফল হবে যদি তিনি তার নিজের গ্রামে কোনো হাসপাতাল স্থাপন করতে পারেন। সে লক্ষ্যে কাজও করে যাচ্ছিলেন যাতে তিনি নিজের এলাকার লোকদের সেবা করতে পারেন।’
সাবিরা জানান, ডা. মঈন প্রতি শুক্রবার তার গ্রামের বাড়িতে যেতেন এবং দরিদ্র গ্রামবাসীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিতেন। ‘আমাদের বাড়ির সামনে তার একটি চেম্বার-কাম-মিটিং রুম ছিল যেখানে লোকেরা তার কাছ থেকে পরামর্শ নেয়ার জন্য আসতেন।’
খসরু জানান, সিলেট শহরে ডা. মঈনের এক খণ্ড জমি আছে এবং যেখানে তিনি বসবাসের বাড়ি ও একটি চেম্বার তৈরির স্বপ্নও দেখতেন। এতেই তার ছোট জীবনকাল অতিবাহিত হয়ে যাবে বলে মনে করতেন ডা. মঈন।
খসরু বলেন, প্রয়াত এ চিকিৎসক ইতোমধ্যে উমরাহ হজ করেছিলেন। তবে, প্রয়াত মায়ের পক্ষে এ বছর হজ করার ইচ্ছা ছিল তার।
খসরু আরও বলেন, ডা. মঈনের ইচ্ছা ছিল তার দুই ছেলের মধ্যে একজন বড় হয়ে যেন ডাক্তার হয় এবং তার এবং তার স্ত্রীর মতো মানুষের সেবা করতে পারে।
রোগীদের একজন ভালো বন্ধু
স্থানীয় সাংবাদিক মোহাম্মদ মহসিন বলেন, ডা. মঈন অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ ও আন্তরিক চিকিৎসক ছিলেন- রোগীদের একজন ভালো বন্ধু ছিলেন। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পরেও তিনি নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবেননি… গভীর রাতেরও রোগীদের সেবা করতে তিনি হাসপাতালে ছুটে যেতেন। সিলেটের রোগীদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন ডা. মঈন।
মহসিন বলেন, ডা. মঈন দরিদ্র রোগীদের শুধু বিনামূল্যে চিকিৎসাই করাতেন না এমনকি যেসব মানুষদের ওষুধ কেনার সামর্থ্য ছিল না তাদের ওষুধও কিনে দিতেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ডা. মঈন মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম চিকিৎসক যিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত বুধবার মারা গেছেন।
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার নিজ গ্রাম নাদামপুরে তাকে দাফন করা হয়।