সুদানের পূর্ব-মধ্যাঞ্চলের একটি শহরে আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের যোদ্ধাদের কয়েকদিনের হামলায় ১২০ জনেরও বেশি লোক নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে চিকিৎসকদের একটি গ্রুপ ও জাতিসংঘ।
সুদানের সামরিক বাহিনীর কাছে একের পর এক বিপর্যয়ের শিকার হওয়ার পর এটি ছিল গোষ্ঠীটির সর্বশেষ হামলা। দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই যুদ্ধ আফ্রিকার দেশটিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। লাখ লাখ জনগণকে বাস্তুচ্যুত করেছে এবং দেশটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে।
আরএসএফ যোদ্ধারা গত ২০-২৫ অক্টোবরের মধ্যে গেজিরা প্রদেশের পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলের গ্রাম ও শহরগুলোতে তাণ্ডব চালান। তারা বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গুলি চালান এবং নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন চালান। এছাড়া তারা খোলা বাজারসহ ব্যক্তিগত ও সরকারি সম্পত্তি লুটপাট করেছে।
ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের ট্র্যাকিং ম্যাট্রিক্সের রবিবারের তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহে তাম্বুল শহর এবং পূর্ব ও উত্তর গেজিরার অন্যান্য গ্রামের ৪৬ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
আইওএমের মহাপরিচালক অ্যামি পোপ আগামী সপ্তাহে সুদান সফরের আগে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে (এপি) বলেন, ‘গেজিরা প্রদেশে হত্যাকাণ্ড এবং ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন সুদানের জনগণের উপর এই সংঘাতের অগ্রহণযোগ্য মানবিক ক্ষতিকে আরও তীব্র করে তুলেছে।’
সংঘাত বন্ধে সমন্বিত আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, 'নষ্ট করার সময় নেই। লাখ লাখ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে।’
সুদানে জাতিসংঘের মানবিক ত্রাণ সমন্বয়কারী ক্লেমেন্টাইন এনকোয়েতা-সালামি শনিবার এক বিবৃতিতে বলেন, 'এগুলো নৃশংস অপরাধ। নারী, শিশু এবং সবচেয়ে অরক্ষিত লোকেরা এমন একটি সংঘাতের ধকল বহন করছে; যা ইতোমধ্যে বহু জীবন কেড়ে নিয়েছে।’
তিনি বলেন, ২০০০ সালের গোড়ার দিকে দারফুর গণহত্যার সময় ধর্ষণ, যৌন সহিংসতা ও গণহত্যাসহ যে ভয়াবহতা সংঘটিত হয়েছিল তার সঙ্গে এই হামলার মিল রয়েছে।
জানজাভিদ নামে পরিচিত আরব মিলিশিয়া থেকে আরএসএফ সৃষ্টি হয়েছিল। সুদানের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ওমর আল-বশির দারফুরের মধ্য বা পূর্ব আফ্রিকান হিসেবে চিহ্নিত জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এসব বিদ্রোহীদের একত্রিত করেছিলেন। এ সময় জানজাভিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, ধর্ষণ ও অন্যান্য নৃশংসতার অভিযোগ আনা হয় এবং দারফুর গণহত্যার সমার্থক হয়ে ওঠে। জানজাভিদ গ্রুপগুলো এখনো আরএসএফকে সহায়তা করছে।
আরও পড়ুন: সুদানে মসজিদে বিমান হামলায় নিহত ৩১
সুদানিজ ডক্টরস ইউনিয়ন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সারিহা শহরে কমপক্ষে ১২৪ জন নিহত ও ২০০ জন আহত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলোতে ত্রাণ সংস্থাগুলো যাতে মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে, সেজন্য 'নিরাপদ করিডোর' খোলার জন্য আরএসএফকে চাপ দিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, 'আহতদের সাহায্য করা বা চিকিৎসার জন্য তাদের সরিয়ে নেওয়ার কোনো উপায় নেই।’
অনলাইনে বেশকিছু ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছে। এর কিছু আরএসএফ যোদ্ধারা নিজেরাই শেয়ার করেছে। সেসব ফুটেজে দেখা গেছে, আধাসামরিক গোষ্ঠীর সদস্যরা বন্দিদের ওপর নির্যাতন করছে। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সামরিক ইউনিফর্ম পরা এক ব্যক্তি এক বৃদ্ধের চিবুক ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন এবং পেছনে অন্য সশস্ত্র ব্যক্তিরা স্লোগান দিচ্ছেন।
ওই ভিডিওতে করা মন্তব্যে আরএসএফ তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেয়নি।
আরএসএফের বিরুদ্ধে গ্রামগুলোতে হামলা চালিয়ে বেসামরিকদের ওপর গুলি চালানোর পাশাপাশি 'বিপুল সংখ্যক বাসিন্দার' সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার অভিযোগ করেছে গণতন্ত্রপন্থি দল ও গোষ্ঠীগুলোর জোট কোঅর্ডিনেশন অব সিভিলিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস।
এক বিবৃতিতে জোটটি 'এই ব্যাপক লঙ্ঘনের জন্য আরএসএফকে দায়ী' করেছে এবং প্রস্তুতকারীদের জবাবদিহির আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে।
সামরিক বাহিনী সফলভাবে আরএসএফের দখলে থাকা এলাকাগুলো পুনরুদ্ধার করার পর গেজিরায় এ হামলা চালানো হলো।
সেপ্টেম্বরে সেনাবাহিনী রাজধানী খার্তুম ও এর আশপাশের এলাকায় ব্যাপক অভিযান শুরু করে এবং আরএসএফের কাছ থেকে বিশাল এলাকা পুনরুদ্ধার করে। এ ছাড়া চলতি মাসের শুরুর দিকে তারা গেজিরা প্রদেশের কৌশলগত পার্বত্য এলাকা জেবেল মোয়া এবং গেজিরা ও নিকটবর্তী সিন্নার প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ দখল করে আরএসএফ বাহিনীকে হটিয়ে দেয়।
অক্টোবরে আরএসএফের একজন শীর্ষ কমান্ডার, গেজিরার ডি ফ্যাক্টো শাসক আবু আকলাহ কেইকেল পক্ষত্যাগ করেন এবং সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
একটি স্থানীয় প্রতিবেদনে বলা হয়, এর ফলে আরএসএফ যোদ্ধারা কেইকেলের অনুগত হিসেবে পরিচিত গেজিরার গ্রাম ও শহরগুলোতে হামলা চালায়।
২০২৩ সালের এপ্রিলে খার্তুমে সামরিক বাহিনী ও আরএসএফের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে সুদানে যুদ্ধ শুরু হয়।
এই যুদ্ধ গণহত্যা এবং জাতিগতভাবে উসকানি দিয়ে হত্যাকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, এসব কর্মকাণ্ড যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল। বিশেষ করে দারফুরের পশ্চিমাঞ্চলে, যেখানে আরএসএফের নৃশংস আক্রমণ চলছে।
সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে পর্যবেক্ষণকারী গোষ্ঠী আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা অনুসারে, সংঘাতে এখন পর্যন্ত ২৪ হাজারেরও বেশি লোক নিহত হয়েছে।
আরও পড়ুন: সুদানে সেনাবাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনীর সংঘর্ষে নিহত ১১