বাস্তবধর্মী শিক্ষাব্যবস্থা, পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান এবং সুরক্ষিত আর্থ-সামাজিক অবস্থা সামগ্রিকভাবে একটি দেশে বজায় রাখে উচ্চশিক্ষার পরিবেশ। এর ধারাবাহিকতায় উন্নত হয় সাধারণ জনজীবন; আর এই উন্নত জীবন ব্যবস্থা দেশটিকে অভিবাসনের উপযুক্ত গন্তব্যে পরিণত করে। বিগত কয়েক দশক জুড়ে এমন কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করেছে ইউরোপের দেশগুলো। অধ্যয়ন ও জীবনযাত্রার খরচ সাশ্রয়ী হওয়ায় দেশগুলোতে ক্যারিয়ার গঠন করছে উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে সেঙ্গেনভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের কাছে অন্যতম জনপ্রিয় একটি রাষ্ট্র ফিনল্যান্ড। এর নেপথ্যে রয়েছে দেশটির বিশ্ব সেরা বিদ্যাপিঠ এবং বহুজাতি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কাজের পর্যাপ্ত সুযোগ। চলুন, ফিনল্যান্ডে উচ্চশিক্ষার আবেদন, অধ্যয়ন খরচ ও স্কলারশিপসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
কেন ফিনল্যান্ড উচ্চশিক্ষার অন্যতম সেরা গন্তব্য
ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই সদস্য রাষ্ট্র পৃথিবীর সব থেকে নিরাপদ দেশগুলোর মধ্যে একটি। ২৬ দশমিক ২ গ্লোবাল ক্রাইম ইন্ডেক্স নিয়ে শীর্ষ সুরক্ষিত দেশগুলোর তালিকায় এর অবস্থান ২৩ নম্বরে। এছাড়া বিশ্বের ১৩তম এই শান্তিপূর্ণ দেশটির গ্লোবাল পিস ইন্ডেক্স ১ দশমিক ৪৭৪।
নিরাপদ পরিবেশের পাশাপাশি ফিনল্যান্ডের বিদ্যাপিঠগুলোর খ্যাতি শুধু ইউরোপেই নয়, গোটা বিশ্ব জুড়ে বিস্তৃত। কিউএস র্যাংকিং-এ ১০৯তম অবস্থানে থাকা ফিনিশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নাম অ্যাল্টো ইউনিভার্সিটি। ১১৫তম র্যাংকটি ধরে রেখেছে ইউনিভার্সিটি অব হেলসিঙ্কি। ইউনিভার্সিটি অব অউলুর অবস্থান ৩১৩ এবং ইউনিভার্সিটি অব তুর্কুর অবস্থান ৩১৫ নম্বরে। ল্যাপেনরান্ত ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি রয়েছে ৩৫১তম র্যাংকে।
আরো পড়ুন: হাঙ্গেরিতে উচ্চশিক্ষা: আবেদনের উপায়, পড়াশোনার খরচ, স্কলারশিপ, ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা
ফিনল্যান্ডে উচ্চশিক্ষায় আবেদনের পূর্বশর্ত
সেঙ্গেনভুক্ত এই দেশের ব্যাচেলর প্রোগ্রামের জন্য উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা, হাই-স্কুল ডিপ্লোমা বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। মাস্টার্স প্রোগ্রামের জন্য প্রয়োজন হবে স্নাতক ডিগ্রি। প্রাসঙ্গিক একাডেমিক বিষয়ে সম্পন্ন ক্রেডিট পয়েন্ট ইসিটিএসেরে (ইউরোপিয়ান ক্রেডিট ট্রান্সফার অ্যান্ড অ্যাক্যুমুলেশন সিস্টেম) সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় জিম্যাট বা জিআরই স্কোর চাইতে পারে। ইউএএস (ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাস্টার্সের জন্য আলাদাভাবে দরকার হবে ২ বছরের প্রাসঙ্গিক কাজের অভিজ্ঞতা। ডক্টরাল প্রোগ্রামগুলোর জন্য স্নাতকোত্তর ডিগ্রির পাশাপাশি গবেষণা প্রস্তাব বা প্রকাশনা থাকতে হবে।
এছাড়া কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির আগে প্রবেশিকা পরীক্ষা, এসএটি পরীক্ষা বা অনলাইন ইন্টারভিউ নেওয়া হতে পারে।
ফিনল্যান্ডের সাধারণ ভাষা ফিনিশ ও সুইডিশ হলেও এখানে ব্যাপক হারে ইংরেজিতে যোগাযোগের প্রচলন আছে। অধিকাংশ ফিনিশরাই বিশেষ করে তরুণরা খুব ভালো ইংরেজি বলতে পারে। তাই আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীদের আলাদা করে স্থানীয় ভাষা জানার দরকার পড়ে না। ইংরেজি ভাষা দক্ষতার জন্য সাধারণত আইইএলটিএস বা টিওইএফএল-এর ফলাফলকে বেশি মূল্যায়ন করা হয়।
আরো পড়ুন: ফ্রান্সে উচ্চশিক্ষা: আবেদন পদ্ধতি, খরচ ও যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা
ফিনল্যান্ডের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চাহিদা সম্পন্ন কোর্সের তালিকা
ফিনল্যান্ডসহ গোটা ইউরোপে বহুল সমাদৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হলো:
* আল্টো ইউনিভার্সিটি
* ইউনিভার্সিটি অব হেলসিঙ্কি
* ইউনিভার্সিটি অব অউলু
* ইউনিভার্সিটি অব তুর্কু
* ল্যাপেনরান্ত ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি
* লুট ইউনিভার্সিটি
* ট্যাম্পেরে ইউনিভার্সিটি
* ইউনিভার্সিটি অব জিভাস্কিলা
* ইউনিভার্সিটি অব ইস্টার্ন ফিনল্যান্ড
* অ্যাবো একাডেমি ইউনিভার্সিটি
* ইউনিভার্সিটি অব ভাসা
আরো পড়ুন: ডুওলিঙ্গো ইংলিশ টেস্ট কী? কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?
ফিনিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়নের সেরা বিষয়গুলো:
* কম্পিউটার সায়েন্স ও আইটি
* ব্যবসায় প্রশাসন
* সাস্টেইনেবল ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি
* রিনিউয়েবল এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিং
* আর্লি চাইল্ডহুড এডুকেশন অ্যান্ড কেয়ার
* ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট
* ডিজাইন ও মিডিয়া
আরো পড়ুন: ডলার এনডোর্সমেন্ট কী, কীভাবে করবেন
ফিনল্যান্ডের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আবেদনের উপায়
ইউরোপের এই দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাধারণত দুটি মৌসুমে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ভর্তি নেয়। অটাম সেমিস্টার যেটি শুরু হয় আগস্ট বা সেপ্টেম্বর থেকে এবং স্প্রিং সেমিস্টার যার শুরু হয় জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে। উভয় ক্ষেত্রে ভর্তির সময়সীমা সাধারণত ৫ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত থাকে।
এখানে মূলত তিনটি উপায়ে বিদেশি ছাত্রছাত্রীরা অনলাইন আবেদন করতে পারে।
* ইউএএসগুলোর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে
* অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে
* স্টাডিইনফোর ওয়েবসাইটে (https://opintopolku.fi/konfo/en/)
ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় বা ইউএএসগুলোর রয়েছে নিজস্ব পদ্ধতি, মানদণ্ড ও নথির তালিকা। তবে ইউনিভার্সিটিগুলো সাধারণত দুটি উপায়ে আবেদন গ্রহণ করে।
*যৌথ আবেদন
* পৃথক আবেদন।
যৌথ আবেদনে একসঙ্গে সর্বোচ্চ ৬টি প্রোগ্রামে আবেদন করা যায়। আর পৃথক আবেদনটি হচ্ছে চিরাচরিত পদ্ধতি, যেখানে একটি প্রতিষ্ঠানে শুধু একটি প্রোগ্রামে আবেদনের সুযোগ থাকে।
আরো পড়ুন: বাংলাদেশে থেকে জার্মান ভাষার আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেট পাওয়ার উপায়
ভর্তির আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাধারণত যে নথিগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেয়, সেগুলো হলো:
* সম্পূর্ণ রূপে পূরণ করা আবেদনপত্র
* একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট ও ডিপ্লোমার প্রত্যয়িত কপি
* ইংরেজি ভাষা দক্ষতার প্রমাণ (আইইএলটিএস বা টিওইএফএল)
* পাসপোর্টের কপি
ইউএএস-এ আবেদনের ক্ষেত্রে
*কর্মসংস্থানের প্রমাণপত্র
*প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থার আবেদন
*মাস্টার্স বা ডক্টরাল প্রোগ্রামের জন্য
*সিভি
* মোটিভেশন লেটার বা পার্সনাল স্টেটমেন্ট
* রেফারেন্স লেটার (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)
* প্রকাশনা (ডক্টরেটের ক্ষেত্রে)
* ইংরেজি ভাষা দক্ষতা সনদ ও পাসপোর্ট ছাড়া বাকি সমস্ত নথি যদি বাংলায় হয়, তাহলে সেগুলোর অফিসিয়াল অনূদিত সংস্করণ সংযুক্ত করতে হবে।
আরো পড়ুন: মালয়েশিয়ায় উচ্চশিক্ষা: উপায়, খরচ ও সুযোগ-সুবিধা
ফিনল্যান্ডের স্টুডেন্ট ভিসার জন্য আবেদন পদ্ধতি
এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের প্রথমে ৯০ দিনের অধিক সময় ফিনল্যান্ডে থাকার জন্য প্রদান করা আবাসিক অনুমোদনের আবেদন করতে হয়। এতে অধ্যয়নের পুরোটা সময়ে দেশটিতে থাকাসহ খণ্ডকালীন চাকরির অনুমতি পাওয়া যায়।
স্নাতকোত্তর অধ্যয়নের জন্য ফিনল্যান্ডে আসতে হলে বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য আবাসিক অনুমোদন নিতে হয়। এক্ষেত্রে ২ বছর পর্যন্ত বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়।
আবাসিক অনুমোদন পাওয়ার সাপেক্ষে ডি টাইপ ভিসার জন্য আবেদন করা যায়। এই ভিসা শিক্ষার্থীকে অবিলম্বে ফিনল্যান্ডে প্রবেশের অনুমতি দেয়। আবাসিক অনুমতি মঞ্জুর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই ভিসার আবেদন শুরু করা উচিত। এতে করে পার্মিট ইস্যূ হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে ফিনল্যান্ড প্রবেশ করে সেখান থেকে বসবাসের অনুমতিপত্র সংগ্রহ করা যায়। অবশ্য ডি ভিসাসহ বসবাসের অনুমতি নিয়ে ফিনল্যান্ডে প্রবেশের জন্য সর্বোচ্চ ১০০ দিন মেয়াদ থাকে।
আবাসিক অনুমোদনের জন্য সরাসরি এন্টার ফিনল্যান্ডের ওয়েবসাইটে (https://enterfinland.fi/eServices/account/emailregistration) অ্যাকাউন্ট তৈরির মাধ্যমে অনলাইন আবেদন করা যাবে। অনলাইনে জমা দেওয়ার পর পূরণ করা ফর্ম ডাউনলোড ও প্রিন্ট করে হাতে স্বাক্ষর করতে হবে। অতঃপর ভিসার অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সঙ্গে একত্রিত করে দূতাবাসে জমা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রাখতে হবে।
আরো পড়ুন: যে ১০টি দেশে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা অল্প খরচে পড়তে পারবেন
ভিসার আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
অনলাইন আবেদন ফর্ম পূরণসহ দূতাবাসে জমা দিতে যে সমস্ত নথি প্রস্তুত করা প্রয়োজন, সেগুলো হলো:
* ফিনিশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ভর্তির অফার লেটার
* বৈধ পাসপোর্ট (কমপক্ষে দুটি খালি পৃষ্ঠা এবং ফিনল্যান্ডে পৌঁছার দিন থেকে অতিরিক্ত ৬ মাস পর্যন্ত মেয়াদ সম্পন্ন)
* আয়ের প্রমাণপত্র (চাকরির সনদ)
* আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রমাণ। শিক্ষাবর্ষের প্রথম বছরের আর্থিক সঙ্কুলানের জন্য প্রতি মাসে কমপক্ষে ৫৬০ ইউরো বা প্রায় ৭১ হাজার ৮৬০ টাকা (১ ইউরো = ১২৮ দশমিক ৩২ বাংলাদেশি টাকা)। অর্থাৎ বার্ষিক ৬ হাজার ৭২০ ইউরোর (প্রায় ৮ লাখ ৬২ হাজার ৩১১ টাকা) ব্যাংক স্টেটমেন্ট প্রদর্শন করতে হবে।
* স্কলারশিপ বা স্পন্সর পেয়ে থাকলে তার প্রমাণপত্র
* স্বাস্থ্য বিমার শংসাপত্র: অধ্যয়নের সময়সীমা ২ বছরের বেশি হলে ১ লাখ ২০ হাজার ইউরো (১ কোটি ৫৩ লাখ ৯৮ হাজার ৪০৫ টাকা)। আর ২ বছরের কম হলে ৪০ হাজার ইউরো (৫১ লাখ ৩২ হাজার ৮০২ টাকা)।
* এছাড়া প্রযোজ্য ক্ষেত্রে দূতাবাস থেকে অতিরিক্ত সংযুক্তি চাওয়া হতে পারে।
আরো পড়ুন: জার্মানিতে বিনামূল্যে স্নাতকোত্তর পড়ার জন্য কিভাবে আবেদন করবেন
দূতাবাসে অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুকিং
এন্টার ফিনল্যান্ড-এ আবেদন সম্পন্ন করার পর প্রথম কাজ হচ্ছে ভারতে অবস্থিত ফিনল্যান্ড দূতাবাসে সাক্ষাৎকারের জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া। এর জন্য https://services.vfsglobal.com/ind/en/frp/register লিংকে নিবন্ধনের মাধ্যমে অনলাইন বুকিং সম্পন্ন করতে হবে। বুকিং দেওয়ার পর নির্দিষ্ট তারিখ এবং সময়ে সাক্ষাৎকারের জন্য অপেক্ষমাণা তালিকা প্রকাশ করা হয়। অতঃপর দিনক্ষণ অনুযায়ী ভিসার আবেদনের যাবতীয় কাগজপত্র মূল কপিসহ দূতাবাসে উপস্থিত হতে হয়।
দূতাবাসের ঠিকানা: ই-৩, ন্যায়া মার্গ, চাণক্যপুরী, নয়া দিল্লি, দিল্লি-১১০০২১, ভারত।
দূতাবাসে সাক্ষাৎকারের পাশাপাশি ফিঙ্গার প্রিন্ট ও ছবি তোলাসহ প্রার্থীর বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করা হয়। সাক্ষাৎকার শেষে আবেদন ফিনিশ ইমিগ্রেশন সার্ভিসে পাঠানো হয়।
আরো পড়ুন: নরওয়েতে বিনামূল্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের উপায়
আবাসিক অনুমোদন প্রাপ্তি
ফিনিশ অভিবাসন সার্ভিসে আবেদন যাচাইয়ের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত খামে (ডিসিশন এনভেলপ) করে দূতাবাসে পাঠানো হয়। এই সিদ্ধান্ত প্রার্থী ই-মেইল এবং এন্টার ফিনল্যান্ডে তার অ্যাকাউন্ট থেকেও দেখতে পারেন। আর খামটি সংগ্রহের জন্য সশরীরে দূতাবাসে উপস্থিত হতে হয়।
সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক হওয়া মানেই এবার শিগগিরই ডি ভিসার জন্য আবেদন করার পালা। সাধারণত ২ সপ্তাহের মধ্যে ভিসা প্রস্তুত হয়ে যায়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১ মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
ভিসা প্রাপ্তির পর ফিনল্যান্ডে প্রবেশ করে আবাসিক অনুমোদন কার্ড সংগ্রহ করা যেতে পারে। মূলত এই অনুমোদনের সিদ্ধান্ত হওয়াটা বেশ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ৬ মাস থেকে শুরু করে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ৯ মাসও লেগে যেতে পারে। তবে সিদ্ধান্ত খাম প্রাপ্তির পর কার্ড তৈরি হতে সময় লাগে ২ সপ্তাহ। এই কার্ড সংগ্রহের সময় বৈধ পাসপোর্টটি অবশ্যই সঙ্গে থাকতে হবে।
আরো পড়ুন: চেক প্রজাতন্ত্রে উচ্চশিক্ষা: পড়াশোনার খরচ ও স্কলারশিপসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা
ভিসা প্রক্রিয়াকরণের আনুষঙ্গিক খরচ
অনলাইনে রেসিডেন্স পার্মিটের আবেদন ফি বা পার্মিটের প্রক্রিয়াকরণ ফি ৩৫০ ইউরো বা প্রায় ৪৪ হাজার ৯১২ টাকা। ডি-টাইপ ভিসার ফি ৯৫ ইউরো (প্রায় ১২ হাজার ১৯১ টাকা)। দূতাবাসের তথা ভিএফএস সার্ভিস চার্জ ৭০ ইউরো (প্রায় ৮ হাজার ৯৮৩ টাকা)।
প্রতিটা ফি অনলাইনে ভিসা বা মাস্টার কার্ড দিয়ে অথবা দূতাবাসে সাক্ষাৎকারের সময়ে পরিশোধ করা যেতে পারে।
উল্লেখ্য যে, অবলাইনে বা কাগুজে আবেদনের ক্ষেত্রে ফি এবং প্রক্রিয়াকরণ সময় উভয়ই তুলনামূলকভাবে বেশি।
আরো পড়ুন: অস্ট্রেলিয়াতে উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ পাওয়ার উপায়
ফিনল্যান্ডে পড়াশোনা ও জীবনযাত্রার সম্ভাব্য খরচ
স্নাতক অধ্যয়নে প্রতি শিক্ষাবর্ষের জন্য বাজেট রাখতে হবে ৪ থেকে ১২ হাজার ইউরো। বাংলাদেশি টাকায় যা প্রায় ৫ লাখ ১৩ হাজার ২৮১ থেকে ১৫ লাখ ৩৯ হাজার ৮৪১ টাকার সমান। আর মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য খরচ হতে পারে ৮ থেকে ১৮ হাজার ইউরো (প্রায় ১০ লাখ ২৬ হাজার ৫৬১ থেকে ২৩ লাখ ৯ হাজার ৭৬১ টাকা)।
পিএইচডির ক্ষেত্রে সাধারণত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে স্পন্সর করা হয়, তাই দেশি-বিদেশি সব শিক্ষার্থীর জন্য টিউশন ফ্রি থাকে। এখানে গবেষণার পাশাপাশি আবাসনের ব্যয়ভারও বহন করা হয়।
ফিনল্যান্ডে বাড়ি ভাড়া বাবদ গড়ে খরচ হতে পারে মাসে ৩ থেকে ৭০০ ইউরো (প্রায় ৩৮ হাজার ৪৯৬ থেকে ৮৯ হাজার ৮২৪ টাকা)। প্রায় ৬০ শতাংশ বিদেশি ছাত্রছাত্রী অধ্যয়নকালে বিভিন্ন শহরের ছাত্রাবাসগুলোতে বসবাস করে। ডর্ম নামের এই আবাসনগুলোর মাসিক ভাড়া প্রায় ২৪০ থেকে ৪২০ ইউরো ( প্রায় ৩০ হাজার ৭৯৭ থেকে ৫৩ হাজার ৮৯৫ টাকা) পর্যন্ত।
নিত্য দিনের খাবারের জন্য ছাত্রছাত্রীরা সাধারণত প্রতি মাসে ১৮০ থেকে ২৪০ ইউরো (প্রায় ২৩ হাজার ৯৮ থেকে ৩০ হাজার ৭৯৭ টাকা) খরচ করে থাকে। প্রতি মাসে যাতায়াত বাবদ খরচ হয় প্রায় ৬০ থেকে ৭৮ ইউরো (প্রায় ৭ হাজার ৭০০ থেকে ১০ হাজার ৯ টাকা)। বিদ্যুৎ ও পানিসহ নানা ইউটিলিটির জন্য মাসিক চার্জ ৮৪ থেকে ১২০ ইউরো (প্রায় ১০ হাজার ৭৭৯ থেকে ১৫ হাজার ৩৯৯ টাকা)।
আরো পড়ুন: অস্ট্রিয়াতে উচ্চশিক্ষা: আবেদন পদ্ধতি, খরচ ও স্কলারশিপসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা
ফিনল্যান্ডে স্কলারশিপের সুবিধা
হেলসিঙ্কি বিশ্ববিদ্যালয় মাস্টার্স ও পিএইচডি প্রোগ্রামগুলোর জন্য বিভিন্ন ধরনের বৃত্তি দেয়। তারমধ্যে ফিনল্যান্ড স্কলারশিপগুলোর মধ্যে রয়েছে সম্পূর্ণ টিউশন ফি মওকুফ এবং ৫ হাজার ইউরোর (প্রায় ৬ লাখ ৪১ হাজার ৬০০ টাকা) বার্ষিক উপবৃত্তি। উপরন্তু, শিক্ষার্থীর একাডেমিক যোগ্যতার উপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ৫০ থেকে শতভাগ অধ্যয়ন ফি মওকুফ করা হয়।
ট্যাম্পেরে ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি স্কলারশিপ মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের জন্য আংশিক থেকে সম্পূর্ণ টিউশন মওকুফ করে থাকে। গ্লোবাল স্টুডেন্ট অ্যাওয়ার্ডে সম্পূর্ণ অধ্যয়ন ফ্রি সহ ৭ হাজার ইউরো (প্রায় ৮ লাখ ৯৮ হাজার ২৪১ টাকা) বার্ষিক উপবৃত্তি পাওয়া যায়।
ডক্টরাল অধ্যয়নে অধ্যয়নের সম্পূর্ণ খরচ বহনসহ মাসিক উপবৃত্তি দেয় ইউনিভার্সিটি অব ইস্টার্ন ফিনল্যান্ড ডক্টরাল স্কলারশিপ। আল্টো ইউনিভার্সিটি স্কলারশিপের আওতায় একাডেমিক যোগ্যতার ভিত্তিতে মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে অধ্যয়নের সুযোগ।
ইরাস্মাস মুন্ডাস জয়েন্ট মাস্টার্স ডিগ্রি স্কলারশিপ যৌথ ডিগ্রি প্রোগ্রামে টিউশন, জীবনযাত্রার খরচ এবং ভ্রমণের খরচ বহন করে।
আরো পড়ুন: আয়ারল্যান্ডে উচ্চশিক্ষা: আবেদনের পদ্ধতি, খরচ, স্কলারশিপ ও যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা
ফিনল্যান্ডে পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরির সুযোগ
ফিনল্যান্ডে অধ্যয়নরত আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা প্রতি সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৩০ ঘণ্টা কাজ করার অনুমতি পায়। এছাড়া গ্রীষ্মের ছুটির সময় কর্মঘণ্টার উপর কোনো সীমারেখা থাকে না।
কাজের প্রকৃতি এবং সেক্টর অনুসারে এই খণ্ডকালীন চাকরি থেকে আয় হয়ে থাকে ঘণ্টা প্রতি ৯ থেকে ১৩ ইউরো (প্রায় ১ হাজার ১৫৫ থেকে ১ হাজার ৬৬৯ টাকা)। রবিবার বা যেকোনো দিন সন্ধ্যার পরবর্তী শিফ্টে কাজ করলে আরও বেশি আয় হয়। তথ্য প্রযুক্তি এবং সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মতো সেক্টরগুলো থেকে তুলনামূলক ভালো উপার্জন আসে।
তাছাড়া বছরে দুটি পিক সিজন থাকে, যখন নিয়োগকর্তারা অন্য সময়ের চেয়ে বেশি নতুন কর্মী নিয়ে থাকেন। একটি হচ্ছে ডিসেম্বরে শীতের বিরতির ঠিক আগে, আর আরেকটি হচ্ছে গ্রীষ্মের বিরতির আগ মুহূর্তে।
সব মিলিয়ে এসব আয় সেমিস্টার চলাকালে শিক্ষার্থীদের জীবনযাত্রার ব্যয়ভার বহনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়ক হয়।
আরো পড়ুন: রোমানিয়ায় উচ্চশিক্ষা: আবেদন পদ্ধতি, খরচ, স্কলারশিপ ও যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা
অধ্যয়ন শেষে চাকরি লাভ ও স্থায়ী হওয়ার সুযোগ
স্নাতক শেষ হওয়ার পর চাকরি খোঁজা বা ব্যবসা শুরুর জন্য অতিরিক্ত ২ বছরের ওয়ার্ক পার্মিটের আবেদন করা যায়। মূলত ফিনল্যান্ডে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য অধ্যয়নের সময়কালসহ দেশটিতে কমপক্ষে একটানা ৪ বছর থাকতে হয়। এর মাঝে কখনও সর্বোচ্চ ৩ মাসের বেশি দেশের বাইরে থাকা যাবে না।
ইউরোপীয় দেশটির উচ্চ মানের জীবনযাত্রার জন্য সেখানে কাজের সুযোগটি কেবল আকর্ষণীয়ই নয়। বরং পর্যাপ্ত ভ্যাকেন্সি থাকায় মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষার্থীদের জন্য তা বেশ সহজসাধ্যও বটে। অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই কাজের সুযোগ করে নিতে পারে। এছাড়া ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব ও সাবলীলতা থাকায় আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীদের জন্য চাকরি পাওয়ার বিষয়টি আরও সহজ করে তোলে।
ফিনল্যান্ডের চাকরির বাজারে আধিপত্য বিস্তার করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে যন্ত্রপাতি তৈরি, কাগজ ও কাঠের পণ্য, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও যানবাহন পরিষেবা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফিনল্যান্ড তথ্য-প্রযুক্তিতে গোটা ইউরোপের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। তাই আইটিতে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের জন্য দেশটিতে রয়েছে ক্যারিয়ারের অপার সম্ভাবনা।
পরিশিষ্ট
ইংরেজি ভাষায় অভ্যস্ত জাতি, পড়াশোনার বাজেট, স্কলারশিপ ও চাকরি; এই সব সুযোগের বিচারে ফিনল্যান্ডে উচ্চশিক্ষা ক্যারিয়ার গঠনের জন্য হতে পারে একটি উপযুক্ত সিদ্ধান্ত। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং স্টুডেন্ট ভিসা আবেদনের প্রক্রিয়াগুলোতে সুষ্ঠ কর্মপরিকল্পনা থাকা জরুরি। অফার লেটারের পরেই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আর্থিক স্বচ্ছলতা এবং চিকিৎসা বিমার জন্য তহবিলের ব্যবস্থাপনা। এছাড়া ফিনল্যান্ড দূতাবাসের মাধ্যমে আবাসিক অনুমোদন এবং ডি-ভিসার আবেদনের মধ্যকার সময়সীমার প্রতি আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। উপরন্ত, এই প্রক্রিয়াগুলো পরবর্তীতে ফিনল্যান্ডে ডিগ্রি পরবর্তী ওয়ার্ক-পার্মিট লাভের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।