১৩ বছর বয়সী মেসি একটা ইউজ ন্যাপকিনে বার্সেলোনার সঙ্গে তার প্রথম কন্ট্রাক্ট সাইন করেন। কারণ তিনি এতটাই উৎসাহিত ছিলেন যে তিনি চেয়েছিলেন ডিনারটা শেষ হওয়ার আগেই যেন তাকে সাইন করিয়ে নেয়া হয়। যে কারণে স্পোর্টিং ডিরেক্টর কার্লস রেসজ্যাগ তখনই সেস্টুর্যান্ট এর ওয়েটারকে ডাক দেন।
তার কাছ থেকে একটা ন্যাপকিন নিয়ে তাতে একটা কন্ট্রাক্ট লিখে ফেলেন। যে ন্যাপকিনটা এখন মেসির উকিলের অফিসে ঝোলানো রয়েছে। যেটাকে বর্তমানে মোস্ট সেলিব্রেটেড পেপার ন্যাপকিন হিসেবে গণ্য করা হয়। ইতিহাস রচনার সূচনাটা হয়েছিল টিস্যু পেপারে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির মাধ্যমে। কে জানত, ওই টিস্যু পেপারের মাধ্যমে হওয়া এক চুক্তি একদিন ফুটবল ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে।
ভিনগ্রহের প্লেয়ার বা রেকর্ড এর বরপুত্র যে নামেই ডাকুন না কেন, বর্তমান বিশ্বের সবথেকে বিধ্বংসী ও ট্যালেন্টেড ফুটবলার – লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। ত্রিশ বছর বয়সেই মেসি যে পরিমাণ এবং যে মাপের রেকর্ড এর মালিক তা কেবল ভিনগ্রহের কারও পক্ষেই সম্ভব।
নিজের শেষ বিশ্বকাপে শিরোপার অন্যতম দাবিদার হিসেবে বিশ্বকাপ খেলতে নেমে শুরুতেই বড় হোঁচট। সৌদি আরবের বিপক্ষে অঘটনের হারের পর গ্রুপপর্বেই বিদায়ের শঙ্কা জেঁকে বসেছিল। সেখান থেকে দুর্দান্তভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে একের পর এক বাঁচা-মরার লড়াই পেরিয়ে, এখন সোনালি ট্রফিটা থেকে নিঃশ্বাস দূরত্বে মেসির আর্জেন্টিনা।
আমাদের মধ্যে খুব কম মানুষই হয়তো এটা জানেন যে মাত্র ১১ বছর বয়সে মেসির গ্রোথ হরমোন ডেফিসিয়েন্সি রোগ ধরা পড়ে। লোকাল পাওয়ার হাউস, রিভার প্লেট তার প্রগ্রেস এর প্রতি ইন্টারেস্টেড ছিল। কিন্তু তারা তার চিকিৎসার জন্য প্রতিমাসে জরুরি ৯০০ ডলার খরচ করতে রাজি ছিল না। কার্লস রেসজ্যাগ যিনি সেই সময় এফ সি বার্সেলোনার স্পোটিং ডিরেক্টর ছিলেন। সৌভাগ্যবশত মেসির ট্যালেন্ট সম্পর্কে তিনি অবগত হন। কারণ ওয়েস্টার্ন ক্যাটালোনিয়া লিডাতে তার কয়েকজন আত্মীয় ছিলেন। যার ফলে মেসি ওতার বাবা এফ সি বার্সেলোনা টিমের সঙ্গে একটা ট্রায়াল অ্যারেঞ্জ করতে সফল হন।
আরও পড়ুন: মেসি-আলভারেজ জাদুতে ৩-০ গোলে ফাইনালে আর্জেন্টিনা
এক সাক্ষাতকারে মেসি বলেন, “টাকা আমার কাছে কোনদিনই অনুপ্রেরণাদায়ক ছিল না। টাকা আমাকে কোনদিনই অনুপ্রেরণা যোগায় না। আমাকে আরও ভালো খেলতে কোনোভাবেই উৎসাহিত করে না। আমি শুধুমাত্র আমার পায়ে একটা ফুটবল থাকলেই খুশি। আমার অনুপ্রেরণা আসে খেলাটা থেকে, যে খেলাটাকে আমি এতটা ভালবাসি। যদি আমি একজন প্রফেশনাল ফুটবলার নাও হতাম, তাও আমি কোন কিছু ছাড়াই সারা জীবন ফুটবল খেলে যেতাম।”
মেসি অন্যান্য গ্রেট ফুটবলারদের মত অতটা লম্বাও নন, অতটা স্বাস্থ্যও ভালো না। কিন্তু তবুও লিও মেসি সারাবিশ্বের সামনে একটা জলজ্যান্ত উদাহরণ হিসেবে গিয়ে এসেছেন। প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, শুধুমাত্র স্বাস্থ্য শরীরই না সেটা ছাড়াও যেটা অনেক বেশি জরুরি তা হল অদম্য মানসিক শক্তি।
মেসিকে অনেক কিছু স্যাক্রিফাইস করতে হয়েছিল যখন মেসি আর্জেন্টিনা ছেড়ে, পরিবার ছেড়ে একটা নতুন জীবন শুরু করার উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু মেসি যা কিছু করেছিলেন শুধুমাত্র ফুটবলের জন্য। মেসির স্বপ্নকে পূরণ করতে।
এই কারণেই আমি অত বেশি পার্টি বা অন্যান্য মজার জিনিস গুলো করে বেড়াই না। এখনো পর্যন্ত তার সব থেকে বেশি আবেগপ্রবণ সাক্ষাৎকারে বার্সেলোনার সেই ছোট তারকাটি বলেছিলেন, যে ঠিক কতটা কষ্ট সহ্য করেও তিনি তার পরিবারকে ছেড়ে, সমস্ত বন্ধুদেরকে ছেড়ে, সমস্ত ইনভাইটেশনকে না করে সে বিদেশ চলে এসেছিল একটা নতুন জীবন শুরু করতে।
এত ছোট বয়সেও তিনি এত বড় একটা ডিসিশন নিয়েছিল। কারণ একদম ছোটবেলা থেকেই তার লক্ষ্য সম্পূর্ণ পরিষ্কার ছিল। সে সব দিনই চেয়েছিল একজন মহান ফুটবলার হতে। আর অন্য কোনো কিছুই তার কাছে তার জীবনে কোনদিনই এর থেকে বেশি মূল্যবান ছিল না।
আরও পড়ুন: লিওনেল মেসি: দুনিয়া কাঁপানো ফুটবলার হয়ে উঠার সচিত্র গল্প
বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড মেসির দখলে
ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে গোল করার মাধ্যমে ফুটবল বিশ্বকাপে ১১ গোল হলো লিওনেল মেসির। এর মাধ্যমে গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে ছাড়িয়ে আর্জেন্টিনার হয়ে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড নিজের দখলে নিলেন তিনি। বিশ্বকাপে বাতিস্তুতার গোল ১০টি।
তাছাড়া ফুটবল বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ (২৫টি) খেলার রেকর্ডেও জার্মানির লোথার ম্যাথিউসের পাশে নাম লিখিয়েছেন আর্জেন্টাইন সুপারস্টার। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে খেলতে নামার মধ্য দিয়ে মেসি ছাড়িয়ে গেছেন জার্মানির মিরোস্লাভ ক্লোসাকে। ক্লোসা বিশ্বকাপে খেলেছেন ২৪ ম্যাচ।
সাত ব্যালন ডি’অর জয়
লিওনেল মেসি তার ক্যারিয়ারে ব্যালন ডি’অর জিতেছেন সাতবার। ব্যালন ডি’অর জেতার দিক থেকে মেসির চেয়ে এগিয়ে আর কেউ নেই।
সবচেয়ে বেশি গোল্ডেন শু জয়ী
ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি বর্ষসেরা হওয়ার কীর্তি মেসির। এক মৌসুমে ইউরোপে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ডটাও তার। ক্যারিয়ারে ছয়বার তিনি জিতেছেন এ ট্রফি। ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯–এই তিন বছর টানা তিনটি গোল্ডেন শু জিতেছিলেন তিনি।
এক পঞ্জিকাবর্ষে সর্বোচ্চ গোল
শেষ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মেসি খেলে যাচ্ছেন সামর্থ্যের সর্বোচ্চটা দিয়ে। তবে ২০১২ সালটাকে মেসির জন্য আলাদা করে রাখতেই হবে। সে বছর মেসির গোলের বাঁধ যেন ভেঙেই গিয়েছিল।
এক ক্লাবের হয়ে সর্বোচ্চ গোল
লিওনেল মেসি গত বছর বার্সেলোনা ছেড়ে যোগ দিয়েছেন ফরাসি ক্লাব পিএসজিতে। তবে তার আগে মেসি ১৭ বছর বার্সেলোনার হয়ে যা করেছেন, তা হয়তো কেউ আর করে দেখাতে পারবে না। বার্সেলোনার জার্সি গায়ে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে তিনি করেছেন ৬৭২ গোল। এক ক্লাবের হয়ে সর্বোচ্চ গোলের তালিকায় তার ধারেকাছে কেউ নেই।
আমরা তাকে নিয়ে অনেক কিছু বলেছি। খবরের কাগজের হেডলাইনে তাকে অবিশ্বাস্য, অতুলনীয়, অদ্বিতীয়, আশ্চর্য থেকে শুরু করে মেসি হলেন ফুটবলের ভগবান। এই অব্দিও বলা হয়েছে। এক্স বাসেলোনা কোচ পেপ গোর্ডেলিও একবার বলেছিলেন, “তার ব্যাপারে কিছু লিখে লাভ নেই। তাকে বর্ণনা করার চেষ্টা করাও বৃথা। শুধু তার খেলাটা দেখুন। আর উপভোগ করুন।”
আরও পড়ুন: বাঁচা-মরার লড়াইয়ে মেক্সিকোর মুখোমুখি মেসির আর্জেন্টিনা