পঞ্চগড়ের বোদায় করতোয়া নদীতে নৌকা ডুবির ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত দল তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। রবিবার রাতে তদন্ত দলের প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপঙ্কর কুমার রায় জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলামের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। সোমবার জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম প্রতিবেদন জমা দেয়ার বিষয়টি জানান।
এদিকে তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়টি গণমাধ্যমকর্মীদের জানানো হয়নি।
গণমাধ্যমকর্মীরা তদন্ত প্রতিবেদনের কপি চাইলে জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম জানান, আপনাদের (সাংবাদিকদের) দেয়া যাবে না, এটি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।
জেলা প্রশাসক আরও জানান, তদন্ত প্রতিবেদনে ভয়াবহ নৌদুর্ঘটনার জন্য খেয়াঘাটের ইজারাদারকে দায়ী করা, মাঝির অদক্ষতা, ধর্মীয় অনুভূতি, অসচেতনতার কারণ উল্লেখ করে বলেন ভৌগলিক পরিস্থিতি ও নদীকেন্দ্রিক জীবন জীবিকাকে উল্লেখ করে ১১৮ পৃষ্টার তদন্ত প্রতিবেদনে বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপন করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে যেন এমন নৌদূর্ঘটনা না ঘটে এজন্য তদন্ত কমিটি পাঁচ দফা সুপারিশ পেশ করেছেন বলে জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন: করতোয়ায় নৌকাডুবি: ৬ষ্ঠ দিনের মত চলছে উদ্ধার অভিযান
এদিকে পুরো তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না করাসহ গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়টি না জানানোয় ভুক্তভোগীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে এ নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা ও প্রকৃত দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে কি না তা নিয়ে আশংকাও সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয়দের দাবি প্রকৃত তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হোক। কি আছে এই তদন্ত প্রতিবেদনে তা জানতে না পারায় সর্বমহলে এ নিয়ে ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে।
অবশ্য তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) দীপঙ্কর কুমার রায় জানান, এলাকার ভৌগলিক পরিস্থিতি এবং নদী কেন্দ্রীক জীবন জীবিকাকে উল্লেখ করে ১১৮ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। তদন্তে সংশ্লিষ্ট সকলের সম্পৃক্ততা উল্লেখ করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম তদন্ত প্রতিবেদন প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, প্রতিবেদনটি মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের কাছে পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে পুলিশ প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসেরও তদন্ত টিম করা হয়েছে। তিনটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা হওয়ার পর মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ যে নির্দেশনা দেবে সে অনুযায়ী পরবর্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মাঝি (নৌকা চালক) জানান, নৌকাটি ছোট ছিল এবং পুরনো ছিল। ওই নৌকায় সবোর্চ্চ ৫০ জনের বেশি যাত্রী তোলা উচিত হয়নি। অতিরিক্ত যাত্রী উত্তোলন করায় চোখের সামনে নৌকাডুবে যাত্রীরা মারা গেছেন।
আরও পড়ুন: করতোয়ায় নৌকাডুবি: দু’দিনে অর্ধশত লাশ উদ্ধার
বধেশ্বরী মন্দির কমিটির সভাপতি নীতিশ কুমার বকশী ওরফে মুকুল বকশী জানান, অনুষ্ঠানের আগে ইজারাদারসহ সংশ্লিষ্ট কমিটির সকলকে ৬টি নৌকা ঘাটে রাখার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ইজারাদার তা করেননি। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও বাকি নৌকাগুলো না আসায় একটিতেই উঠে পার হওয়ার চেষ্টা করেন পুণ্যার্থীরা। দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্যান্য কর্মকর্তারা ঘাটে সজাগ থাকলে এমন দুর্ঘটনা এড়ানো যেত।
ঘাটে উপস্থিত পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও গ্রাম পুলিশের সদস্যদের আরও কঠোর হয়ে অতিরিক্ত যাত্রী উঠতে বাধা না দেয়ারও সমালোচনা করেন নিতিশ কুমার।
মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু আনছার মো. রেজাউল করিম (শামীম) জানান, নৌকাডুবির ব্যাপারে জেলা পরিষদ এবং ইজারাদার দায় এড়াতে পারেন না। ঘাটের কোনো উন্নয়ন হয়নি। এখানে আমাদের ইউনিয়ন পরিষদ বা আমার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই।
সমাজকর্মী আব্দুল্লাহ আল জুবেরী জানান, মহালয়ার মত বড় অনুষ্ঠানের জন্য যেমন সমন্বয় দরকার হয়, আয়োজনকারি কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসনসহ সকল সংশ্লিষ্ট পক্ষের মধ্যে তেমন কোন সমন্বয় ছিলো না। একারণে কয়েক মিনিটের ব্যাবধানে শুধু মাত্র দায়িত্বশীল পদাধিকারীক ব্যক্তিদের উদাসীনতা অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার কারণে পরিবারগুলো ভগ্নাংশে পরিণত হয়েছে।
তিনি আরও জানান, এদেশে মানুষ যখন কোথাও বিচার পায় না তখন সে আদালতে যায় এই আশায়, যে সেখানে সে বিচার পাবে। আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে কত বিষয়েই ব্যাখ্যা দাবী করেন। এই ৬৯ জন লাশ ৩ জন অতল জলে হারিয়ে যাওয়া মানুষ কি আদালতের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়ার মতো পর্যাপ্ত মনে হবে না?
সমাজকর্মী আব্দুল্লাহ আল জুবেরী জানান, মহালয়ার মত বড় অনুষ্ঠানের জন্য যেমন সমন্বয় দরকার হয়, আয়োজনকারী কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনসহ সকল সংশ্লিষ্ট পক্ষের মধ্যে তেমন কোন সমন্বয় ছিলো না। একারণে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে শুধুমাত্র দায়িত্বশীল পদাধিকারীক ব্যক্তিদের উদাসীনতা অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার কারণে পরিবারগুলো ভগ্নাংশে পরিণত হয়েছে।
আরও পড়ুন: করতোয়ায় ট্রলারডুবি: নিহত বেড়ে ২৫
তিনি আরও জানান, এদেশে মানুষ যখন কোথাও বিচার পায় না তখন সে আদালতে যায় এই আশায়, যে সেখানে সে বিচার পাবে। আদালত স্বপ্রনোদিত হয়ে কত বিষয়েই ব্যাখ্যা দাবী করেন। এই ৬৯ জন লাশ ৩ জন অতল জলে হারিয়ে যাওয়া মানুষ কি আদালতের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়ার মতো পর্যাপ্ত মনে হবে না?
জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ সানিউল কাদের জানান, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের হস্তান্তরিত ফেরীঘাটের ইজারা ও ব্যবস্থাপনা এবং উদ্ভুত আয় বন্টন সম্পর্কে নীতিমালা ২০০৩ অনুযায়ী জানা এসব ঘাট পরিচালনা করা হচ্ছে। নদী বন্দরগুলোর জন্য বন্দর পরিদর্শক বা ফিটনেস দেখভালের জনবল রয়েছে। কিন্তু বর্তমান যে আইন রয়েছে তাতে এখানে এমন কোন নীতিমালা নেই। এজন্য প্রয়োজন আইনী কাঠামো। এটা হলে ঘাটগুলো কিভাবে চলবে। নৌযানগুলো কেমন হবে, কোন যন্ত্রের সাহায্যে চলবে, সবোর্চ্চ যাত্রী কত হবে, জনবল কাঠামো কেমন হবে এমন নানা বিষয় নির্দেশনা থাকতো। থাকতো ঘাট পরিদর্শক বা ফিটনেস পরীক্ষক। তাহলে নৌকার ফিটনেস যাচাই করা সম্ভব হতো।
জেলা পরিষদের প্রশাসক আনোয়ার সাদাত সম্রাট জানান, বধেশ্বরী মন্দিরে মহালয়ার পূজা উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একটি কমিটি করে দেয়া হয়। তারা অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যানও উপস্থিত ছিলেন। তারা মাঝিকে নির্দেশ দিলে এত যাত্রী উঠত না। এত মৃত্যুর ঘটনাও ঘটত না। ওই নৌদুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি করা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক দীপঙ্কর কুমার রায় এই কমিটির আহ্বায়ক।
তিনি জানান, তদন্তের পর দায় কার তা বোঝা যাবে।
এদিকে পঞ্চগড়ের নৌকাডুবির ঘটনায় দশম দিনেও সীমিত আকারে উদ্ধার অভিযান চলেছে। কিন্তু এখনো নিখোঁজ কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বোদা উপজেলা ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের ভারপ্রাপ্ত স্টেশন অফিসার শাহজাহান আলী জানান, অভিযানে এখন পর্যন্ত কোন অগ্রগতি নাই। মাটি এবং বালির নিচে লাশগুলো চাপা পড়ে যেতে পারে।
এ জন্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিদিন সকাল এবং বিকালে উদ্ধার অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।