পুরো আসরজুড়ে নিজেদের খুঁজতে থাকা ইংল্যান্ড অবশেষে জ্বলে উঠল। সমর্থকদের নিজেদের স্বভাবসুলভ ফুটবল উপহার দিয়ে জয়ও ছিনিয়ে নিল শেষ মুহূর্তে।

বুধবার রাতে ডর্টমুন্ডের জিগনাল ইডুনা পার্কে নেদারল্যান্ডসকে ২-১ গোলে হারিয়েছে ইংল্যান্ড।

ম্যাচে প্রথমার্ধের ৭, ১৮ ও ৯০তম মিনিটের শেষ সেকেন্ডে তিনটি গোল দেখে দুই দলের সমর্থকরা, যার প্রথমটি ছিল নেদারল্যান্ডসের, পরের দুটি ইংল্যান্ডের।

এই ম্যাচে শুধুই জয় নয়, ফাইনালে দুর্দান্ত স্পেনের মোকাবিলা করার আগে ফর্মে ফেরার ইঙ্গিত দিয়ে সমর্থকদের মনে আশার সঞ্চার করেছে ইংল্যান্ড।

আরও পড়ুন: ‘সুপার সাব’-এ শেষ মুহুর্তে ডাচদের হুদয় ভেঙে ফাইনালে ইংল্যান্ড

এদিন শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলা শুরু করে নেদারল্যান্ডস। এর ফল পেতেও বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা লাগেনি তাদের। ম্যাচের সপ্তম মিনিটেই গোল করে দলকে এগিয়ে নেন পিএসজির ডাচ মিডফিল্ডার জাভি সিমোন্স।

সতীর্থের থ্রু বল পেয়েই বক্সের সামনে থেকে ডেকলান রাইসকে পরাস্ত করে জোরালো শট নেন ২১ বছর বয়সী সিমোন্স। বল গোলরক্ষক জর্ডান পিকফোর্ডকে ফাঁকি দিয়ে গন্তব্যে চলে যায়।

গোল খেয়েই ম্যাচে ফেরে ইংল্যান্ড। একের পর এক আক্রমণে উঠতে থাকে গ্যারেথ সাউথগেটের শিষ্যরা।

দশম মিনিটে ২৫ গজ দূর থেকে ফ্রি কিক পায় ইংল্যান্ড। তবে বক্সর ভেতর থেকে তা ফিরিয়ে দেয় নেদারল্যান্ডস। পরের মিনিটে ফের প্রায় একই জায়গা থেকে ফাউল থেকে ফ্রি কিক আদায় করে ইংল্যান্ড। এবার গোলের সম্ভাবনা তৈরি হলেও অফসাইডে সুযোগটি নষ্ট হয়।

ত্রয়োদশ মিনিটে বক্সের বেশ দূর থেকে জোরালো শট নেন হ্যারি কেইন। তবে ঝাঁপিয়ে তা ঠেকিয়ে দেন ডাচ গোলরক্ষক। পরের মিনিটে কেইনের আরও একটি দারুণ প্রচেষ্টা গোলপোস্টের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়।

আরও পড়ুন: দলীয় ঐক্য ও তারুণ্যের চমকে ফ্রান্সকে বিদায় করে ফাইনালে স্পেন

এসময় বক্সের মধ্যে কেইনের শটটি প্রতিহত করতে গিয়ে তার পায়ে আঘাত করেন ডেনসেল ডুমফ্রিস। শুরুতে রেফারি ফাউল না ধরলেও ভিএআর রিভিউ দেখে ইংল্যান্ডকে পেনাল্টি উপহার দেন তিনি। যদিও রিপ্লেতে সেটিকে ফাউল বলে মনে হচ্ছিল না, টিভি ধারাভাষ্যকারদেরও মত ছিল তা-ই, তবে রেফারির সিদ্ধান্তই যেখানে চূড়ান্ত, সেখানে বিতর্ক হলেও রায় যায় ইংল্যান্ডের পক্ষে।

ফলে ১৮তম মিনিটে পেনাল্টি থেকে দলকে সমতায় ফেরান কেইন। কেইনের বাঁ পাশে নেওয়া শটের দিকেই ঝাঁপ দিয়েছিলেন ডাচ গোলরক্ষক বার্ট ভেব্রুখেন, তবে একেবারেই কোণা দিয়ে নেওয়া শটটি তিনি প্রতিহত করতে ব্যর্থ হন।

গোল পেয়ে ফের ডাচদের চেপে ধরে ইংল্যান্ড। এরইমধ্যে ২৩তম মিনিটে গোল প্রায় পেয়েই গিয়েছিলেন ফোডেন। তবে গোললাইন থেকে ডুমফ্রিসের অনবদ্য রক্ষণে নিশ্চিত গোলটি থেকে বঞ্চিত হয় ইংল্যান্ড।

সতীর্থের বল ধরে ডান পাশ থেকে ডাচ বক্সের মধ্যে ঢুকে একেবারেই কোণা দিয়ে ভেরব্রুখেনকে পরাস্ত করেন ফোডেন। তবে বল যখন গোললাইন অতিক্রম করছে, ঠিক তখনই তা থামিয়ে দেন ডুমফ্রিস। রিভিউতে দেখা যায় মাত্র কয়েক ইঞ্চির কারণে বল গোললাইন অতিক্রম করেনি। ফলে হতাশ হন ফোডেন।

এরপর আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে দুই দলই গোলের সুযোগ তৈরিতে মনোযোগী হয়। ২৮তম মিনিটে নেদারল্যান্ডসের একটি পাল্টা আক্রমণ কর্নারের বিনিময়ে প্রতিহত করে ইংল্যান্ড। কর্নার থেকে আসা শট থেকে ফের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল ডাচদের। তবে ডুমফ্রিসের হেডার ওপরের পোস্টে লেগে ফিরে আসলে হতাশ হন তিনি।

৩২তম মিনিটে ফোডেনের আরও একটি দর্শনীয় শট দূরের পোস্টের কোণায় লেগে বাইরে বেরিয়ে যায়। ফলে এক রাতে আগে লামিন ইয়ামালের মতো হুবহু একটি গোল থেকে বঞ্চিত হন ম্যানচেস্টার সিটির এই তরুণ প্রতিভা।

৩৫তম মিনিটে চোট পেয়ে মাঠ ছাড়তে হয় ডাচ ফরোয়ার্ড মেম্ফিস ডিপাইকে। তার বদলি হিসেবে মাঠে নামেন পিএসভি আইন্ডহোভেন মিডফিল্ডার জোয়ি ফিয়ারমান। ইংলিশদের একের পর এক আক্রমণে বিপর্যস্ত দলকে বাঁচাতে এসময় আক্রমণভাগের পরিবর্তে মাঝমাঠে শক্তি বাড়ান রোনাল্ড কুমান।

এরপর কিছুটা ঝিমিয়ে পড়া খেলায় ফের উত্তেজনা ফেরান ফোডেন। দূরের পোস্টে তার নেওয়া মাটি কামড়ানো আরও একটি দারুণ শট ঝাঁপিয়ে ঠেকান ভেরব্রুখেন।

অতিরিক্ত যোগ করা তিন মিনিটের শেষ সময়ে একটি ভালো প্রচেষ্টা চালায় নেদারল্যান্ডস। তবে শেষ পর্যন্ত ইংলিশ রক্ষণে তা প্রতিহত হলে ১-১ গোলের সমতায় বিরতিতে যায় দুই দল।

আরও পড়ুন: স্পেন-জার্মানি সেমিফাইনাল: ম্যাচজুড়ে যা হলো

প্রথমার্ধে গোল খাওয়ার পর থেকে ম্যাচে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে ইংল্যান্ড। মাঝেমধ্যে ডাচরা দুয়েকটি আক্রমণে উঠলেও বেশিরভাগ সময় ইংল্যান্ডের আক্রমণ সামলাতে নিজেদের বক্সের সামনেই ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় তাদের।

এই অর্ধের আলোর পুরোটা কেড়েন নেন ম্যানসিটি উইঙ্গার ফিল ফোডেন ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ১৯ বছর বয়সী মিডফিল্ডার কোবি মাইনু।

প্রথমার্ধে ৬৩ শতাংশ সময় বলের নিয়ন্ত্রণ রাখা ইংল্যান্ড গোলের উদ্দেশ্যে ৭টি শট নেয়, যার চারটিই লক্ষ্য ছিল। শুধু তাই নয়, তিনটি থেকেই গোল পাওয়ার সুযোগ ছিল। অপরদিকে, প্রথমার্ধে তিনটি শট নিতে পারে নেদারল্যান্ডস, যার গোল পাওয়া ওই একটি শটই লক্ষ্যে ছিল, একটি পোস্টে লেগে ফিরে আসে এবং আরেকটি রক্ষণে প্রতিহত হয়।

বিরতি থেকে ফেরার সময় অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ডনিয়েল মালেনকে তুলে ইউনাইটেডের উইঙ্গার ভাউট ভেগহোর্স্টকে মাঠে নামান কুমান, অপরদিকে কিরান ট্রিপিয়ারকে বসিয়ে ইনজুরি থেকে ফেরা লুক শকে খেলতে পাঠান সাউথগেট।

শুরু থেকে দুই দলই গুছিয়ে খেলতে থাকে। এরইমধ্যে ৪৯তম মিনিটে প্রথম আক্রমণে ওঠে ইংল্যান্ড। বুকায়ো সাকা টাচলাইন ধরে এগিয়ে বক্সের মধ্যে বল বাড়ালেও সতীর্থের অভাবে সুযোগটি নষ্ট হয়।

এরপর খেলার গতি খানিকটা পড়ে যায়, মাঝমাঠেই ঘুরতে থাকে বল। তবে ৬১তম মিনিটে ডাচদের একটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

এরপর ৬৫তম মিনিটে বক্সের বেশ বাইরে একটি ফ্রি কিক আদায় করেন জাভি সিমোন্স, যা থেকে গোল পেয়েই যাচ্ছিল নেদারল্যান্ডস। তবে ঝাঁপিয় দারুণভাবে শট ঠেকিয়ে দলকে বাঁচান জর্ডান পিকফোর্ড। এর চার মিনিট পর ডাচদের আরও একটি উঁচু শট লাফিয়ে উঠে ঠেকিয়ে দেন ইংলিশ গোলরক্ষক।

আরও পড়ুন: শাস্তি পেতে পারেন বেলিংহ্যাম

৭৪তম মিনিটে বিপদে পড়েই গিয়েছিল ইংল্যান্ড। বক্সের সামনে থেকে ইংল্যান্ডের দুর্বল পাস ধরেই বাঁ দিক থেকে এগোতে থাকা কোডি গাকপোকে বল বাড়ান এক সতীর্থ। তবে বল তার কাছে পোঁছানোর আগমুহূর্তে স্লাইড ট্যাকলে আক্রমণটি নিষ্ক্রিয় করে দেন কাইল ওয়াকার।

এসময় প্রায় ১৫ মিনিট ধরে বলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখে একের পর আক্রমণে ওঠে নেদারল্যান্ডস। আর রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলতে শুরু করে ইংল্যান্ড।

৭৮তম মিনিটে এমনই একটি আক্রমণ থেকে শট নেন সিমোন্স। তবে শটটি মাঝে ড্রপ করে গতি কমে যাওয়ায় সহজেই বল সংগ্রহ করেন পিকফোর্ড।

দীর্ঘ সময় পর ৭৯তম মিনিটে প্রথমবার আক্রমণে উঠেই গোল পেয়ে যায় ইংল্যান্ড। ডান দিক থেকে এগিয়ে গিয়ে বক্সের মধ্যে মাইনু ক্রস দিলে প্রথম ছোঁয়াতে তা থেকে গোল আদায় করেন সাকা। তবে সঙ্গে অফসাইডের পতাকা তুলে দেন লাইন ম্যান। ফলে ইংলিশ ফুটবল সমর্থকরা হতাশ হয়।

এরপরই দ্বিতীয়ার্ধে নিষ্প্রভ ফিল ফোডেন ও কেইনকে তুলে কোল পালমার ও অলি ওয়াটকিন্সকে নামান সাউথগেট।

শেষের দশ মিনিটে ধীর লয়ে গেম ডেভেলপমেন্টের পথ বেছে নেয় দুই দলই। বল পেলে ঠান্ডা মাথায় আক্রমণ তৈরি করছিল তারা। তবে ৮৪তম মিনিটে চকিতে আক্রমণে উঠে ইংলিশ রক্ষণ ভাঙার চেষ্টা করে নেদারল্যান্ডস। তবে রক্ষণেই সে প্রচেষ্টা কাটা পড়ে।

পরের মিনিটে নেদারল্যান্ডসের একটি পাল্টা আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে ২৫ গজ দূরে গাকপোকে ফাউল করে কার্ড দেখেন সাকা। তবে ফ্রিক কিক থেকে আসা ক্রসে মাথা ছোঁয়াতে ব্যর্থ হন ডাচ অধিনায়ক ভার্জিল ফন ডাইক।

আরও পড়ুন: বিরল কীর্তিতে রোনালদোর পাশে বসলেন ইয়ামাল

৮৮তম মিনিটে পালমারের জোরালো শট পোস্টের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। পরমুহুর্তেই ইংল্যান্ডের বক্সের সামনে ফাউল করায় শেষ হয়ে যায় আরও একটি ডাচদের পাল্টা আক্রমণ।

তবে ম্যাচের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার ঠিক শেষ সেকেন্ডে গোল পেয়ে যায় ইংল্যান্ড। ধীরে ধীরে আক্রমণে উঠে চকিতে দুর্দান্ত একটি থ্রু বল বাড়ান কোল পালমার। তা ধরেই একজন ডাচ ডিফেন্ডারকে পরাস্ত করে ঘুরেই দুরুহ কোণ থেকে দূরের পোস্টে শট নেন ওয়াটকিন্স। বুলেট গতির সেই শট ভেরব্রুখেনকে পরাস্ত করে ঢূকে যায় গোলে।

এরপর দুই মিনিট অতিরিক্ত খেলা হলেও ডাচদের আটকে রাখতে সক্ষম হয় ইংল্যান্ড। ফলে নেদারল্যান্ডসের হৃদয় ভেঙে শেষ মুহূর্তের গোলে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালে উঠে যায় গ্যারেথ সাউথগেটের শিষ্যরা।

আগামী রবিবার বাংলাদেশ সময় রাত একটায় বার্লিনের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে তিনবারের চ্যাম্পিয়ন স্পেনের বিপক্ষে প্রথম ইউরো শিরোপার সন্ধানে মাঠে নামবে থ্রি লায়ন্স।