বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ বাংলাদেশ লালন শাহ, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দের বাংলাদেশ। এ বাংলাদেশ শাহজালাল, শাহ পরান, শাহ মকদুম, খানজাহান আলীর বাংলাদেশ। এ বাংলাদেশ শেখ মুজিবের বাংলাদেশ, সাড়ে ১৬ কোটি বাঙালির বাংলাদেশ। এ দেশ সকলের। এ দেশে ধর্মের নামে আমরা কোনো ধরনের বিভেদ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে দেব না।’
প্রধানমন্ত্রীর এ ভাষণ রাষ্ট্রয়ত্ত বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বাংলাদেশ বেতারে একযোগে সম্প্রচার করে। এছাড়া দেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এবং রেডিও স্টেশনগুলোতেও এ ভাষণ প্রচার করা হয়।
আরও পড়ুন: শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার: প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা বলেন, সম্প্রতি ১৯৭১’র পরাজিত শক্তির একটি অংশ মিথ্যা, বানোয়াট, মনগড়া বক্তব্য দিয়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করতে মাঠে নেমেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা ১৯৭২ সালে বলেছিলেন ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার না করতে। কিন্তু পরাজিত শক্তির দোসররা দেশকে আবার ৫০ বছর আগের অবস্থায় ফিরে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
তারা রাজনৈতিক মদদে সরকারকে ভ্রুকুটি দেখানোর পর্যন্ত ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে বলে প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, ধর্মান্ধ নয়। ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার করবেন না। প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার রাখেন।’
শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন যে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান- সকল ধর্মের-বর্ণের মানুষের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। ‘ধর্মীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে এ দেশের মানুষ প্রগতি, অগ্রগতি এবং উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে।’
আরও পড়ুন:প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে শিল্পীরা চমৎকার কাজ করেছেন: তথ্যমন্ত্রী
তিনি স্বাধীনতার পর, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ মেয়াদে এবং গত ১২ বছরে দেশে ইসলামকে বিকশিত করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরেন।
রক্তের ঋণ
শেখ হাসিনা ১৮ মিনিটের ভাষণে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে লাখ লাখ শহিদের রক্তের ঋণ ভুলে না যাওয়ার জন্য শপথ নেয়ার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘আমরা যেন মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ভূলুণ্ঠিত হতে না দেই। যুবশক্তি, তরুণ সমাজ এবং নতুন প্রজন্মের কাছে অনুরোধ, তোমরা তোমাদের পূর্বসূরীদের আত্মোৎসর্গের কথা কখনই ভুলে যেও না। তাদের উপহার দেয়া লাল-সবুজ পতাকার অসম্মান হতে দিও না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই বিজয় দিবসে যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষদের বিজয়-নিশান সমুন্নত রাখার শপথ নাও। প্রতিজ্ঞা কর, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এ দেশকে সোনার বাংলাদেশে পরিণত করবে। তবেই ৩০ লাখ শহিদের আত্মা শান্তি পাবে। জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণ হবে।’
আরও পড়ুন: হাই-টেক পার্কে বিনিয়োগের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতি আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
কোভিডের মধ্যে বিজয় দিবস
কোভিড-১৯ মহামারি সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ বছর আমাদের বিজয় দিবস উদযাপন করতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে আমাদের দৈনন্দিন কার্যপ্রণালীতে পরিবর্তন আনতে হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে, জনসমাগম এড়িয়ে আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম সম্পন্ন করতে হচ্ছে। প্রতিটি মানুষের জীবনই মহা মূল্যবান। কোনো অবহেলায় একজন মানুষেরও মৃত্যু কাম্য নয়।’
প্রধানমন্ত্রী সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিজয় দিবস উদযাপনসহ যাবতীয় কাজকর্ম সম্পন্ন করার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘আপনারা ঘর থেকে বের হওয়ার সময় অবশ্যই মাস্ক পরিধান করবেন এবং মাঝে মধ্যে হাত সাবান অথবা স্যানিটাইজার দিয়ে পরিষ্কার করবেন। আপনার সুরক্ষা, সকলের জন্য রক্ষাকবচ।’
আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে মুগ্ধ বৃটেন ও তুরস্কের রাষ্ট্রদূত
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ বছরটি শুধু আমাদের জন্যই নয়, বিশ্ববাসীর জন্য এক দুর্যোগময় বছর। করোনাভাইরাসের মহামারি স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার পাশাপাশি অর্থনীতির ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বিশ্ব অর্থনীতি এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে। করোনাভাইরাসের মহামারির ফলে অনেক উন্নত এবং উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির মুখে পড়েছে।’
বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে আমরা সময়োচিত পদক্ষেপ এবং কর্মসূচি গ্রহণ করে এই নেতিবাচক অভিঘাত কিছুটা হলেও সামাল দিতে সক্ষম হয়েছি। আমরা প্রায় ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি যা জিডিপির ৪ দশমিক ৩ শতাংশ।’
প্রাথমিক ধাক্কা সামলিয়ে দেশের প্রবাসী আয়, কৃষি উৎপাদন এবং রপ্তানি বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
আরও পড়ুন:সমাজে নারীদের অবস্থান শক্তিশালী করতে কাজ করছে সরকার: প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের বৃহৎ প্রকল্পগুলোর কাজ পূর্ণ গতিতে এগিয়ে চলছে। আমাদের স্বপ্নের ও গর্বের পদ্মা সেতুর সবগুলো স্প্যান বসানো শেষ। ঢাকায় মেট্রোরেলের কাজ আবার পুরোদমে শুরু হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ এই মহামারিতে এক দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলির নদীর তলদেশে ট্যানেল নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের মহাসড়কগুলো চার-লেনে উন্নয়নের কাজও পুরোদমে এগিয়ে চলছে।
তিনি বলেন, ‘চলতি বছর আমরা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা উদযাপন করছি। যদিও করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের কর্মসূচিতে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হয়েছে।’
‘আগামী বছর আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি। করেনাভাইরাসের এই মহামারি না থাকলে আমরা যথাযথ উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব উদযাপন করতাম,’ বলেন তিনি
সামনে এগিয়ে যাওয়া
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু বলতেন ভিক্ষুক জাতিকে কেউ সম্মান করে না।
তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের সেই দুর্নাম ঘুচিয়েছি। আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ আজ একটি সমীহের নাম। আজকের বাংলাদেশ আর অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর বাংলাদেশ নয়। আজকের বাংলাদেশ স্বাবলম্বী বাংলাদেশ।’
আরও পড়ুন: কোভিডের প্রকোপ হ্রাসে শক্তিশালী আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা দরকার: প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সামিল হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি।’
‘জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। আমরা তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। তবেই ২০৪১ সালের মধ্যে আমাদের উন্নত, সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে,’ বলেন প্রধানমন্ত্রী।