নবজাতক, শিশু ও বয়স্কসহ বিভিন্ন শ্রেণির নারী-পুরুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রথমে প্রছন্দের কোন হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার জন্য ভর্তি হলেও উন্নত চিকিৎসা এবং আর্থিক সংকটে পড়ে নিম্ন-মধ্যম ও দরিদ্র শ্রেণির রোগীরা ছুটে যান কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এটি বৃহত্তর কুমিল্লা (কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) এবং জেলার ১৭ উপজেলার নিম্ন-মধ্যম ও দরিদ্র শ্রেণির মানুষের চিকিৎসা সেবার একমাত্র ভরসা। কিন্তু প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ ও অতিরিক্ত লোকবল সংকটে রোগীরা কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছেন না ।
নবজাতক ওয়ার্ডে ওয়ার্মার ও ফটো থেরাপি মেশিনের সংকট লেগে আছে। এছাড়া নেই ইনকিউবেটর, এনআইসিইউ ও স্ক্যানো ইউনিট। মুমূর্ষু রোগীদের জন্য নেই আইসিইউ, সংকট রয়েছে অক্সিজেনের। তাছাড়া অন্যান্য রোগীদের চিকিৎসাসেবা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের সংকট পুরোনো। কোনটি নষ্ট, বিকল এবং কিছু যন্ত্রাংশে ত্রুটি থাকায় রোগ নিরীক্ষায় ভুল রিপোর্টে বিভ্রান্ত হতে হয় রোগীদের।
এছাড়াও চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীর তুলনায় আসন সংকট, প্রয়োজনের তুলনায় ক্লিনারের অভাবে বাথরুম ও শৌচাগার থাকে অপরিচ্ছন্ন, সুপেয় পানির অভাব এবং ট্যাপের পানি লাল রঙের ময়লা ও দূষিত। এই পানি ব্যবহারে রোগী ও তার স্বজনরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন। এসব সমস্যা ও সংকট মহামারি আকার ধারণ করেছে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রকোপ শীত ও শৈত্যপ্রবাহে গত ৪-৫ দিনে কুমেকে নবজাতক ও শিশু ওয়ার্ডে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। চিকিৎসা সেবায় নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ, রয়েছে সংকট। তিনটি ওয়ার্মারের মধ্যে দু’টি নষ্ট, তিনটি ফটো থেরাপি’র মধ্যে দু’টি নষ্ট, চারটি এনআইসিইউ সিট থাকলেও বর্তমানের নবজাতকের চিকিৎসা সেবায় ব্যবহার করার জন্য নেই একটিও। এছাড়া শিশুর মৃত্যুর হার রোধ এবং সংকটাবস্থা নবজাতক ও শিশু চিকিৎসা সেবায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ এনআইসিইউ এবং স্ক্যানো ইউনিট নেই। রয়েছে জনবল সংকট। যার কারণে অত্যাধুনিক এসব গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশের অভাবে সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিমাসে গড়ে ১২-১৫ জন শিশু ও নবজাতক মারা যাচ্ছে।
নবজাতক ওয়ার্ডের ইনচার্জ শাহানাজ বেগম জানান, মায়ের গর্ভ থেকে নির্দিষ্ট সময়ের আগে জন্ম নেওয়া, ওজন কম, শারীরিক গঠন তুলনায় ছোট এবং জন্মের পর শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত শিশুদের মেডিকেল কলেজের নবজাতক ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। এদিকে শীতে ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর পরিমাণ আরও বাড়ছে। এই ওয়ার্ডে চিকিৎসায় ব্যবহার করা তিনটি ওয়ার্মার ও তিন ফটোথেরাপি মেশিনের মধ্যে মাত্র দু’টি যন্ত্রাংশ কাজ করছে। চারটি ইনকিউবেটর থাকলেও এখন একটিও নেই। নবজাতক রোগীর তুলনায় যন্ত্রাংশ ও লোকবল সংকট থাকায় সঠিক চিকিৎসা সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
রোকসানা আক্তার নামে এক নবজাতকের স্বজন জানান, কুমিল্লার একটি হাসপাতালে সিজারের মাধ্যমে সাত মাস ২২ দিনের মাথায় নবজাতকটি জন্ম নেয়। জন্মের পর তার ওজন কম এবং শ্বাসকষ্ট অতিরিক্ত হওয়ায় চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়েছে ওয়ার্মার বা এনআইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখার জন্য। কুমিল্লা মেডিকেল হাসপাতালের নবজাতক ওয়ার্ডে শিশুটিকে আনা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা ওয়ার্মারে রাখার কথা বললেও নার্সরা জানান তিনটি ওয়ার্মারের মধ্যে দু’টি নষ্ট। বাচ্চা রাখা যাবে না। বর্তমানে শিশুটিকে নিয়ে খুব বিপদে রয়েছি।
শিশু ও নবজাতক বিভাগের প্রধান ডা. মো. আজিজুল হোসেন বলেন, শীত আসলে শিশু ও নবজাতক ওয়ার্ডে রোগীর সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পায়। এসব রোগীদের সেবা দিতে আমাদের বিপাকে পড়তে হয়। কারণ প্রয়োজনীয় মেশিন ও যন্ত্রাংশের অনেক সংকট। যেগুলো আছে সেগুলো প্রায় সময় কাজ করে না। নবজাতক ওয়ার্ডে প্রতিদিন গড়ে ৭-৮টি শিশু জন্ম নেয়। শিশুর মৃত্যুরোধে খুব শিঘ্রই স্ক্যানো ইউনিট চালু এবং ওয়ার্মার এবং এনআইসিইউসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আনার চেষ্টা করছি।
কুমেকের পরিচালক জানায়, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৭৯ জন জনবল সংকট রয়েছে। মঞ্জুরীকৃত ৭০৯ জন জনবলের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে ৬২৯ জন। দীর্ঘদিন শুন্য রয়েছে ৭৯ জন জনবল।
এদিকে কুমেকে দালালের উৎপাত এবং চিকিৎসকদের দায়িত্ব অবহেলা চরম আকার ধারণ করেছে। রোগীরা হাসপাতালে সেবা নিতে আসলে মেডিকেল কলেজের যন্ত্রাংশ নষ্ট বা সমস্যা আছে জানিয়ে চিকিৎসকরা পছন্দের ফার্মেসিতে ওষুধ এবং বেসরকারি হাসপাতালে নিরীক্ষার জন্য পরামর্শ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। দিনের বেলায় অনেক চিকিৎসক মেডিকেলে না এসে শহরের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল বা নিজস্ব চেম্বারে বসে রোগী দেখেন। এদিকে রাতের বেলায় ইমার্জেন্সিসহ পুরো হাসপাতালে কোন চিকিৎসক থাকেন না। জরুরি বিভাগসহ মেডিকেলের প্রত্যেক ওয়ার্ডে শিক্ষানবিশ কিছু চিকিৎসক দায়িত্বে থাকলেও ঘুমিয়ে রাত কাটান। যার ফলে রোগী ও তার স্বজনরা চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
অন্যদিকে জরুরী বিভাগে একটি মাত্র লিফ্ট রয়েছে। এটি বিভিন্ন সময় বিকল হয়ে ভিতরে রোগী ও স্বজনরা আটকে পড়ে। রয়েছে আসন সংকট, অতিরিক্ত রোগীরা ফ্লোরে এদিক সেদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে হয়। তবে কুমেকের নতুন পরিচালক হাসপাতালের আশপাশ ও আঙ্গিনা পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা রাখার ভূমিকা রেখেন। যা রোগীদের দৃষ্টি কেড়েছে।
কুমেকে চিকিৎসা সেবা নিতে আশা মনোয়ার হোসেন রুবেল জানান, গত সপ্তাহে আমার এক মামাকে সংকটাবস্থায় মেডিকেলে আনার পর দেখি জরুরী বিভাগে চিকিৎসক নেই। লাইফ সাপোর্ট দেওয়ার মতো আইসিইউ না থাকায় আমরা বিপাকে পড়ে যাই। পরে তাড়াতাড়ি অক্সিজেন ব্যবহারে এম্বুলেন্স যোগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। কুমিল্লায় এতো বড় একটি হাসপাতাল যেখানে হাজার হাজার মানুষ সেবা নিতে আসে, সেখানে লাইফ সাপোর্ট দেওয়ার মতো কোন যন্ত্রাংশ নেই। আমাদের দাবি মেডিকেলে আইসিইউসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ সেবা চালু করা হোক।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. আমিন আহমেদ খান বলেন,আইসিইউ, স্ক্যানো ইউনিট চালুর জন্য আমরা কাজ করছি, খুব শিঘ্রই মানুষ সেবা নিতে পারবে। এদিকে আমাদের শিশু ও নবজাতক ওয়ার্ডে যন্ত্রাংশের অনেক সংকট রয়েছে। সেগুলো নিয়েও আমরা কাজ করছি। দালালের উৎপাত, রোগীদের ভোগান্তি এধরনের কোন অভিযোগ নির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত হলে সাথে সাথে আমরা ব্যবস্থা নিবো।
তিনি আরও বলেন, কুমেক দীর্ঘদিন একটি সমস্যায় পড়ে আছে। তা হচ্ছে পানিতে আয়রন, ট্যাপের পানি ময়লা ও লাল রঙের পানি পড়ায় বাথরুম ও শৌচাগারের ফ্লোরগুলো লাল হয়ে যাচ্ছে। এই বিষয়গুলো একাধিকবার পিডব্লিউডিকে জানানো হয়েছে।