কোভিড-১৯ মহামারির কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় বেশির ভাগ শিশু এখন তাদের বাড়িতে বন্দী। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শিশুদের অনেকেই তবুও ভাইরাসের শিকার যেহেতু আজকাল তারা পর্দার সামনে- মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ বা টিভিতে সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশু এবং তাদের গ্যাজেট আজ অবিচ্ছেদ্য, এবং এটি তাদের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনকও হতে পারে। এছাড়া, লকডাউন-সম্পর্কিত বিধিনিষেধের কারণে দীর্ঘায়িত বিচ্ছিন্নতা তাদের বাড়ির ভেতরে থাকতে বাধ্য করছে। আর এতে শহুরে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ।
আমেরিকান সাইকোলজিকাল অ্যাসোসিয়েশন কোভিড পরবর্তী বিশ্বে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলে, 'বিচ্ছিন্নতা বোধ থেকে কম ঘুম, দুর্বল হৃদয়, নিম্ন প্রতিরোধ ক্ষমতা, বিষণ্ণতা এবং প্রতিবন্ধী এক্সিকিউটিভ ফাংশন হতে পারে।'
গত বছর ৮ মার্চ দেশে প্রথম কোভিড-১৯ শনাক্তের পরগত বছরের ১৭মার্চ সরকার সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের ভাইরাস থেকে রক্ষা করতে গত এক বছরে এই বন্ধটি বেশ কয়েকবার বাড়ানো হয়েছে।সম্প্রতি, এই মাসেও স্কুল বন্ধের সময়সীমা বাড়ানো হয়।
আরও পড়ুন: করোনা ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি ঈদ পর্যন্ত বাড়তে পারে: মন্ত্রী
যেহেতু সারাদেশে শিক্ষাবোর্ড পরীক্ষা দিতে পারছে না, তাদের পূর্ববর্তী পরীক্ষার ফলাফল মূল্যায়নের ভিত্তিতে সকল শিক্ষার্থীকেপরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা হয়।
তবে অভিভাবকরা দাবি করেন, গত এক বছর ধরে বাসায় থেকে ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে তাদের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রেখে, ল্যাপটপ বা কম্পিউটারে গেমস খেলে, পড়াশোনা করে এবং মোবাইল ফোনে পরিচিতদের সাথে সংযুক্ত হয়ে গ্যাজেটে আসক্ত হয়ে পড়েছে। আরএসব কিছুই তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা ফারজানা ফেরদৌসি ইউএনবিকে বলেছেন, 'আমার দুই বাচ্চা নাজিরাবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। স্কুল বন্ধ হওয়ার পর থেকে তারা কেবল তাদের বাড়িতেই বন্দী রয়েছে। সবসময় রিমোট স্টাডির পর তারা মোবাইল ফোনেই আঁকড়ে থাকে। কোভিড পূর্ব সময়ে স্থানীয় খেলার মাঠে খেলাধুলাতারা কখনই মিস করবে না।'
ফারজানা বলেছিলেন,গ্যাজেটের অত্যধিক ব্যবহারদেখে মনে হচ্ছে বাচ্চাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে। তিনি যোগ করেন, 'গ্যাজেট এবংফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য আমার বাচ্চারা খুব দেরিতে ঘুম থেকে ওঠছে। আমাদের শৈশবে আমরা কখনও গ্যাজেট ব্যবহার করার সুযোগ পাইনি, সম্ভবত এ কারণেই আমরা এখনও ফিট এবং সুস্থ রয়েছি।'
সর্বশেষ জাতীয় কৈশোর স্বাস্থ্য ও সুস্থতাসমীক্ষা অনুসারে, বাংলাদেশে ৯০ শতাংশেরও বেশি কিশোর-কিশোরী মোবাইল ফোন ব্যবহার করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'সমীক্ষার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার অবস্থা পরীক্ষা করা এবং বোঝা। ১০ জন অবিবাহিত ছেলের মধ্যে সাত জনই একটি মোবাইল ফোনের মালিক। অবিবাহিত পুরুষদের প্রায় অর্ধেক এবং বিবাহিত ও অবিবাহিত কিশোরীদের এক পঞ্চমাংশ কিশোরীরা সপ্তাহে অন্তত একবার ইন্টারনেটে প্রবেশ করে।'
আরও পড়ুন: শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবিতে রাজশাহীতে মানববন্ধন
যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিকাল মেডিসিনের ডা. এসএম আমানের মতে, গবেষণায়দেখাযায় যে দীর্ঘক্ষণ সেলফোন এক্সপোজার শিশুদের আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে। 'গবেষণায় যে শিশুদের হাইপারএক্টিভবা সংবেদনশীল বা আচরণগত সমস্যাসহ অন্যান্য শিশুদের সাথে মিশতে না পারার সমস্যা ছিল তাদের মায়েদের গর্ভকালীন সময়ে সেলফোন ব্যবহারের সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল,'তিনি বলেছিলেন।
'শিশুরা টিভি দেখতে, গেম খেলতে, ফোন কল করতে এবং বার্তা প্রেরণে সেলফোন ব্যবহার করে। অনেক বয়স্ক বাচ্চা এবং কিশোর-কিশোরীর নিজস্ব সেল ফোন রয়েছেযাতে তারা ২৪/৭ঘন্টা সংযুক্ত থাকে। তবে শিশুদের এগুলো ঘন ঘন ব্যবহারের ঝুঁকি রয়েছে এবং যদি তাই হয় তবে এটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ঝুঁকির চেয়ে আলাদা।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সাবেক ছাত্র জানিয়েছেন, সেলফোন মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ নির্গত করে। 'সেলফোন নিরাপদ কিনা তা নিয়ে বিজ্ঞানী সম্প্রদায়ের উদ্বেগ রয়েছে। ক্যান্সার একটি বিশেষ উদ্বেগ, তবে যেহেতু ক্যান্সারবিকশিত হতে ১০-২০বছর সময় নেয় এবং শিশুদের ঘন ঘন সেল ফোন ব্যবহার তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক বিকাশ, তাই উত্তরর চেয়েআরও বেশি প্রশ্ন রয়েছে,' তিনি যোগ করেছেন।
বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির প্রভাষক রহিমা আক্তার বলেছেন, কিশোর-কিশোরীরা ঘরে বসে প্রতিদিন কমপক্ষে ছয় বা সাত ঘণ্টা ডিভাইসবিশেষত মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। 'গ্যাজেটের অতিরিক্ত ব্যবহার মস্তিষ্কের উপর চাপ সৃষ্টি করে যা মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়ায়। সুতরাং, কিশোর-কিশোরীদের ডিভাইসের পরিবর্তে খেলার মাঠে খেলতে হবে।'
অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা অভিভাবকদের প্রতি তাদের সন্তানদের সাথে পারিবারিক বন্ধন বাড়ানোর সুযোগটি কাজে লাগানোর জন্য পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন: করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে না: প্রধানমন্ত্রী
মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালের ডা. খায়রুল বাশার বলেছেন, দীর্ঘ সময় ধরে সমাজের অবশিষ্ট অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সাধারণত শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক সুস্থতায় ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। 'সাধারণ ক্রিয়াকলাপ থেকে বিচ্ছিন্নতা শিশুদের এমন এক সঙ্কটে ফেলে দেয় যা মানসিক রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে এবং এতে তীব্র স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, অ্যাডজাস্টমেন্ট ডিসঅর্ডার, এবং পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার এবং মনোযোগ-ঘাটতি হতে পারে।
'তবে শিশুরা বাড়িতে বন্দী থাকাকালীন পেরেন্টিং দক্ষতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পিতামাতা এবং শিশুদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়াকে বাড়িয়ে তোলার জন্য একটি ভাল সুযোগ হলো বাড়িতে থাকাটা। সঠিক পেরেন্টিংপদ্ধতির মাধ্যমেপারিবারিক বন্ধন আরও দৃঢ় হতে পারে,' তিনি যোগ করেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের চেয়ারম্যান প্রফেসর নূর মুহাম্মদ বৈদ্যুতিক ডিভাইস ব্যবহার না করে আরও বেশি বই পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন। 'এই মহামারি চলাকালীন সরকার বিশেষজ্ঞদের দ্বারা টেলি কাউন্সেলিং পরিষেবা চালু করতে পারে।'