শুধুমাত্র তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভর না করে দেশের আয়ের উৎসকে বৈচিত্র্যময় করতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও টেকসই হবে বলে জানিয়েছে থাইল্যান্ড।
ঢাকায় নিযুক্ত থাই রাষ্ট্রদূত মাকাওয়াদি সুমিতমোর বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি ও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতেও আগ্রহী।
রাষ্ট্রদূত মাকাওয়াদি সুমিতমোর সম্প্রতি বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘তৈরি পোশাকের ডিজাইনের বিষয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এবং স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোকে বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতা করার যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে আরএমজি পণ্যের দাম বাড়ানোর কথাও বিবেচনা করা উচিত বাংলাদেশের।’
তিনি বলেন, দুই দেশই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
রাষ্ট্রদূত বলেন, গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ তার ক্রমবর্ধমান মাথাপিছু আয় দিয়ে ক্রমান্বয়ে দেশ গড়েছে।
তিনি আরও বলেন, মহামারি সত্ত্বেও অব্যাহত জিডিপি প্রবৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশ কয়েক বছরের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে।
মাকাওয়াদি বলেন, তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের সাফল্য মুগ্ধ করার মতো এবং বাংলাদেশকে যথার্থই ‘ওয়ার্ড্রোব অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ বলা যেতে পারে। নিজেদের এই অসাধারণ কাজের প্রমাণ বিশ্বের কাছে দিয়েছে বাংলাদেশ।
এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত সুমিতমোর বলেন, বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থাইল্যান্ডের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সম্ভাব্যতার বিষয়ে একটি সমীক্ষা চালাচ্ছে। যদি এ চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয় তবে শুল্ক নিয়ে প্রতিবন্ধকতা হ্রাস পাবে এবং বাণিজ্য প্রবাহ বৃদ্ধি করবে।
তিনি আর বলেন, থাইল্যান্ড স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) জন্য শুল্কমুক্ত কোটা ফ্রি (ডিএফকিউএফ) প্রকল্প অনুমোদন করেছে। যার অর্থ বাংলাদেশ শুল্ক ছাড়াই থাইল্যান্ডে সাত হাজার ১৮৭টি কৃষি ও শিল্প পণ্য রপ্তানি করতে পারে।
থাই রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির একটি উপায় হচ্ছে সরাসরি সমুদ্র পরিবহন রুট স্থাপন করা।
আরও পড়ুন: পালাউয়ের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাৎ
তিনি বলেন, ‘আমরা গত ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম বন্দর এবং রনং বন্দরের মধ্যে সরাসরি উপকূলীয় শিপিং পরিষেবা চালু করার জন্য একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছি।’
শিপমেন্টগুলো আগে সিঙ্গাপুর বা শ্রীলঙ্কার মাধ্যমে ট্রানজিট করতে হয়, যার জন্য ১২-১৫ দিন সময় লাগে। তবে দুই বন্দরের মধ্যে সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী সময় ও খরচ কমাতে রনং বন্দর ও চট্টগ্রাম বন্দরের মধ্যে সরাসরি উপকূলীয় শিপিং রুট স্থাপনের চেষ্টা করছে দুই দেশ। এটি বাস্তবায়িত হলে শিপমেন্টগুলো পরিবহনের সময় অন্তত তিন দিন কমে যাবে।
রাষ্ট্রদূত বলেন, থাইল্যান্ডের একটি স্থল সেতুর মাধ্যমে আন্দামান উপকূলের রনং বন্দরকে থাইল্যান্ড উপসাগরের চুমফোন বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত করার একটি প্রকল্প রয়েছে।
তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ মালাক্কা প্রণালী ছাড়াও প্রশান্ত মহাসাগরের দেশগুলোতে পণ্য রপ্তানির বিকল্প পথ পাবে।
বাংলাদেশের প্রতি থাইল্যান্ডের নীতি:
রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশের প্রতি থাইল্যান্ডের নীতি সব সময়ই বন্ধুত্ব ও সহযোগিতাপূর্ণ ।
তিনি বলেন, গত পাঁচ দশকে দুই দেশ বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং যোগাযোগের মতো বেশ কিছু ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি করেছে।
রাষ্ট্রদূত সুমিতমোর বলেন, বাংলাদেশ আসিয়ানের নিকট প্রতিবেশি এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করতে পারে।
তিনি বলেন, একই সঙ্গে থাইল্যান্ড প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য বিমসটেক, আইওআরএ এবং এসিডির মতো আঞ্চলিক ও বহুপাক্ষিক কাঠামোতে বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা জোরদার করবে।
বিমসটেক বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কারণ ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে পরবর্তী শীর্ষ সম্মেলন পর্যন্ত থাইল্যান্ড বিমসটেক-এর নতুন চেয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে বলেও জানান তিনি।
কোভিড পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারে অগ্রাধিকার
রাষ্ট্রদূত অনেকগুলো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে উষ্ণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ বলে বর্ণনা করেন। তবে তিনি মনে করেন সম্পর্ক আরও জোরদার করার জন্য এখনও যথেষ্ট ক্ষেত্র বাকি রয়েছে।
তিনি বলেন, কোভিড-১৯ সহযোগিতার গতিসহ আমাদের জীবনের প্রায় প্রতিটি দিককে প্রভাবিত করেছে।
রাষ্ট্রদূত বলেন, সৌভাগ্যক্রমে স্বাভাবিক জীবন ও ব্যবসা-বাণিজ্য ধীরে ধীরে আবার শুরু হচ্ছে।
আরও পড়ুন: মার্কিন প্রেসিডেন্টের জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত জন কেরির সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক
সবুজ অংশীদারিত্ব
রাষ্ট্রদূত সুমিতমোর বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ড একই চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের অনেক এলাকার মতোই ব্যাংককও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ২ মিটার উঁচু।
তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব বিবেচনা করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল করার মতো বাংলাদেশের প্রচেষ্টার প্রশংসা করি আমি।
রাষ্ট্রদূত বলেন, থাইল্যান্ড জাতীয় উন্নয়নের জন্য অন্তর্নিহিত ধারণা হিসেবে বায়ো-সার্কুলার-গ্রিন ইকোনমি বা বিসিজি মডেল গ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা আরও প্রযুক্তি বান্ধব হওয়ার পরিকল্পনা করছি এবং থাই অর্থনীতিকে আরও মূল্য-ভিত্তিক এবং টেকসই করতে আরও সবুজ হতে চাই।’
এটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে বাংলাদেশের নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। "সুতরাং আমি মনে করি উভয় পক্ষই সর্বোত্তম অনুশীলন বিনিময় এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি কার্যক্রম সংগঠিত করার জন্য একটি "সবুজ অংশীদারিত্ব" গঠন করতে পারে।"
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন
রাষ্ট্রদূত সুমিতমোর বলেন, থাইল্যান্ড মানবিক সহায়তা প্রদান, বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের প্রত্যাবাসনের সুবিধার্থে এবং রাখাইন রাজ্যে টেকসই উন্নয়নের প্রচারে ভূমিকা পালনের জন্য আসিয়ানকে সমর্থন দিতে থাকবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা এই সমস্যার একটি টেকসই সমাধান দেখতে চাই এবং আমরা সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সঙ্গে আমাদের অংশীদারিত্ব অব্যাহত রাখতে প্রস্তুত।’
থাইল্যান্ড ২০১৭ সাল থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গাদের মৌলিক চাহিদা প্রদানের জন্য জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা যেমন ইউএনএইচসিআর, ডব্লিউএফপি এবং ডব্লিউএইচও- এর মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা দিয়েছি।
এবছরও তারা কক্সবাজারের একটি ক্যাম্পে একটি রিসোর্স সেন্টার সংস্কার করতে ইউনিসেফের সঙ্গে সহযোগিতা করছে বলেও জানান রাষ্ট্রদূত।
পর্যটন সম্ভাবনা
রাষ্ট্রদূত বলেন, থাইল্যান্ড বাংলাদেশি পর্যটকদের প্রিয় গন্তব্য। ২০১৯ সালে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার বাংলাদেশি থাইল্যান্ডে গিয়েছিলেন। যার মধ্যে চার হাজার ৩০০ জন চিকিৎসার জন্য যান বাকিরা পর্যটনের উদ্দেশে যান।
তিনি বলেন, ‘তারা থাই অর্থনীতিতে প্রায় ৬ দশমিক ৭ বিলিয়ন থাই বাত সরবরাহ করেছে।
সুমিতমোর বলেন, ‘থাইল্যান্ডের পর্যটন কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের ভ্রমণকারীদের সঙ্গে ‘পুনরায় যুক্ত হতে’ সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। ‘এমনকি তাদের বাংলায় একটি নিউজলেটার এবং ইনস্টাগ্রাম রয়েছে।’
তিনি বলেন, থাইল্যান্ড ও থাইল্যান্ডের জনগণের প্রতি বাংলাদেশিদেরও খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব রয়েছে, যা দূতাবাসের কাজকে অনেক সহজ করে তোলে।
রাষ্ট্রদূত বলেন, এর বিপরীতে ২০১৯ সালে মাত্র চার হাজার ৮০০ জন থাই নাগরিক বাংলাদেশ সফর করেছেন। যাদের বেশিরভাগই কাজের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন।
তিনি পরামর্শ দেন, ‘ভারত, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যুক্ত বৌদ্ধ সার্কিটের অংশ হিসেবে আমরা বাংলাদেশে বৌদ্ধ ঐতিহাসিক স্থানগুলোর প্রচারণা শুরু করতে পারি। যাতে (বাংলাদেশের বৌদ্ধ ঐতিহাসিক স্থানগুলোর প্রতি) আরও বেশি তীর্থযাত্রী ও ভ্রমণকারীদের আকৃষ্ট করা যায়।’
আরও পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কেনার চুক্তি করছে না বাংলাদেশ: পররাষ্ট্র সচিব