খুলনায় করোনার প্রভাব আর দীর্ঘ বিধিনিষেধ ও কঠোর লকডাউনে তৃণমূল পর্যায়ের নিম্ন আয়ের মানুষ বর্তমানে দুর্দিনে কাটাচ্ছে। করোনার ঊর্ধ্বমুখী গতি আর দীর্ঘ লকডাউনের কারণে এ সকল নিন্ম আয়ের মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে এখন কর্মহীন হয়ে পড়েছে।
দেশের চলমান করোনাভাইরাসে প্রকোপ আর দীর্ঘ লকডাউনে অনেকটাই জীবন্ত মৃত্যু ঘটাচ্ছে এসকল নিম্ন আয়ের মানুষদের। যার প্রভাবে চরম কষ্টে দিন নিপতিত করছেন তারা। এই তালিকায় আছেন ফুটপাতের ব্যবসায়ী, শ্রমিক, দিন মুজুর, রিকশা-ভ্যান ইজিবাইক, মাহেন্দ্র চালকেরা।
রিকশাচালক মকবুল হোসেন জানান, করোনাভাইরাসের শুরু হতে আজ পর্যন্ত অনেক কষ্টে আছি। তারপর বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনের চাপের মুখে রিকশা চালাতে পেরেছি। এক বেলা রিকশা চালিয়ে যে টাকা উপার্জন হয়েছে তাই দিয়ে গোটা পরিবারের ভরণ-পোষন চালিয়েছি। আর বর্তমান সময়ে কঠোর লকডাউনের কারণে রিকশা রাস্তায় উঠতে দিচ্ছে না। যদি প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাস্তায় উঠছি সাথে সাথে হাওয়া ছেড়ে দিচ্ছে প্রশাসনের লোকজন। তাছাড়া কঠোর লকডাউনের কারণে প্রশাসনের লোক বেশি রাত পর্যন্ত রিকশা চালাতে দেয় না।
সোনাডাঙ্গার রাজমিস্ত্রির হেলপার মহিদুল বলেন, ‘করোনার কারণে কেউ বাড়ির তৈরি বা মেরামতের কাজ করাচ্ছে না। তারপর আবার মরার উপর খাড়ার ঘাঁ। একেই তো করোনার বিস্তার বেড়েছে অন্যদিকে কঠোর লকডাউনের কারণে প্রশাসন রাস্তায় নামলেই কেন রাস্তায় নেমেছি জিজ্ঞাসা করছে। কিন্তু কেউ দু’কেজি চাল কিনে দেয় না। লকডাউনের কারণে সম্পূর্ণ বেকার হয়ে পড়েছি।’
দৌলতপুর আমতলার কাঠ মিস্ত্রি লিটন, করোনা শুরু হতে ধরতে গেলে সম্পূর্ণ বেকার। তারপর আবার ঘাড়ের উপর সমিতির কিস্তির ভারী বোঝা। দোকানে কোন ক্রেতা নেই, নেই কোন কাজের অর্ডার।
আরও পড়ুন: নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য নির্দিষ্ট কোনো বরাদ্দ নেই, অভিযোগ বিএনপির
তিনি বলেন, ‘একেই কাজ নেই তারপরও দোকান খুলে বসে থাকতাম। মাঝে মাঝে দু’একটি কাস্টমার আসতো। কিন্তু লকডাউনের কারণে বর্তমানে দোকান খুললেই প্রশাসনের লোক বন্ধ করে দেয়।’
খালিশপুরের ফুটপাতের কাপড় ব্যবসায়ী রফিক, খালিশপুর পিপলস্ জুট মিলে বন্ধ হওয়ার পর কাটা সিট কাপড় কিনে এনে ফুটপাথে বসে বিক্রি করছিল।
তিনি জানান, লকডাউনের কারণে দোকান সম্পূর্ণ বন্ধ। পরিবারের ভরণ-পোষন জোগাড়ে হিমশিম খাচ্ছি। জানিনা সামনের দিনগুলো কেমন যাবে?
সব মিলিয়ে বর্তমানে কঠোর লকডাউনের প্রভাবে খুলনার নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষগুলো চরম উৎকন্ঠা আর দুর্দিনে দিন নিপতিত করছে। করোনা প্রভাবে দীর্ঘ লকডাউন ব্যবসায়ীদের করে তুলেছে সর্বশান্ত, তারা নিজ পরিবারের ভরণ-পোষন যোগাতে বর্তমানে হিমহিম খাচ্ছে।
চলমান লকডাউনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহলের কারণে খুলনা শহরের প্রধান সড়কগুলো অনেকটাই ফাঁকা। কিন্তু অলিগলি ও পাড়া-মহল্লার সড়ক লোকে লোকারণ্য।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে রাস্তার ওপারে খাবারের হোটেল। সেখানে ক্রেতাদের বসেই খাবার খেতে দেখা যায়। এর সামনে গলির মধ্যে কয়েকটি চায়ের দোকান। সেখানেই মানুষের আড্ডাস্থল।
নগরীর গোবরচাকা মধ্যপাড়ায় গলির রাস্তায় দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছেন উঠতি বয়সী যুবকের পাশাপাশি বয়স্করাও। কেউ দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছেন, কেউ বা গলির মধ্যে খোশগল্পে মেতে আছেন। অধিকাংশরই মুখে মাস্ক নেই।
নগরীর সদর হাসপাতালের গলির ভেতরে চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছেন কয়েকজন যুবক। জানতে চাইলে বলেন, ঘরে আর কতক্ষণ। চা খেয়ে বন্ধুদের সাথে একটু আড্ডা দেবো। তারপর বাসায় চলে যাবো।
নগরীর মৌলভী পাড়ায় গলির রাস্তায় দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিলো চার কিশোর। তাদের সবাই এবারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। কিন্তু করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় স্থগিত হয়ে যাওয়া পরীক্ষা নিয়ে চলছিলো তাদের আড্ডা।
এদের একজন সাব্বির বললো আসলে ঘরে বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। এ সময় পরীক্ষার পড়াও পড়তে ইচ্ছা করছে না। কারণ, পরীক্ষা কবে হবে তার কোনো ঠিক নেই।
আরও পড়ুন: করোনায় খুলনাতে আরও ১১ জনের মৃত্যু
প্রশ্ন তুলে আমিরুল ইসলাম নামের একজন বলেন, লকডাউন কি শুধু দিনের জন্য, রাতের জন্য না? অফিস বন্ধ, গাড়ি চলাচল বন্ধ। কেউই খুলনার বাইরে যেতে পারবে না, আর শহরের বাইরে থেকেও কেউ আসতে পারবে না। কিন্তু এখন গণপরিবহন বন্ধ আর অফিস খোলা।
খুলনার সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি না হলে লকডাউন কার্যকর করা কঠিন। তারপরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অবিরাম পরিশ্রম করছেন, জেল-জরিমানাও করা হচ্ছে। তারপরও লোকজন ঠেকানো যাচ্ছে না। পুলিশ চলে গেলেই তারা আবার আড্ডায় মেতে উঠছেন। তবে, এ বিষয়ে প্রশাসন কঠোর ভূমিকায় রয়েছে বলেও জানান তিনি।