এখানে বগা হল ইভ্যালির প্রধান উদ্যোক্তা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাসেল ও তাঁর সহধর্মিনী কোম্পানির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন। তারা ফান্দে পড়েছে সন্দেহ নেই। তবে কান্না করছে কীনা বুঝা যাচ্ছে না। তবে তাঁদের পাতা ফাঁদে পড়ে শহর ও গ্রামগঞ্জের লাখ লাখ ক্রেতারা যে পথে বসেছে ও সব হারিয়ে পাগল প্রায় এব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
বলা হচ্ছে, এক হাজার কোটি টাকার দেনার বিপরীতে ইভ্যালির ব্যাংক একাউন্টে জমা আছে সর্বসাকুল্যে ৩৫ লাখ টাকা অনুষ্ঠানিক ঘোষণা না হলেও, কোম্পানীটি বস্তুত: দেউলিয়া হয়ে গেছে।
২০১৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবসে সাবেক ব্যাংকার এবং শিশুদের ডায়াপার বিক্রেতা রাসেল কোম্পানিটির যাত্রা শুরু করেন। শুনেছি এর পরিশোধিত মূলধন ছিল মাত্র এক কোটি টাকা। এরপরের গল্পটি ছেড়া কাঁথা থেকে রাজকন্যা বনে যাওয়া সিন্ডেরেলার মত। বাংলাদেশের ই-কমার্সের আকাশে যেন এক ধূমকেতুর আর্বিভাব। চারিদিকে হৈ হৈ কাণ্ড, চমকের পর চমক। একটি মোটর সাইকেল কিনলে দুটো পাবেন। লাখ টাকার জিনিস ৪০ হাজার টাকায়। সঙ্গে এলো চোখ-ঝলসানো, হৃদয়- কাঁপানো বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনে নাট্য ও সিনেমা জাগতের তারকারা এলো তাদের ভাবমূর্তির আলোর ঝলকানি নিয়ে। জাতীয় ক্রিকেট দলের পৃষ্টপোষক, র্যাবের জন্য ফিল্ম তৈরি, সরকারি অনুষ্ঠানের পৃষ্টপোষকতা, ই-কমার্স এসোসিয়েশনের অনুষ্ঠানের অর্থের যোগান দাতা। পত্রিকায় এলো চটকদার বিজ্ঞাপন, টেলিভিশনে যত টকশো তার স্পনসর হিসাব এলো ইভ্যালি। মতমাতানো জিংগেলে মানুষের স্বপ্নের ডানা মেলে দেবার আহ্বান ও আকাংখা পূরণের অঙ্গীকার। স্বপ্নের ডানা মেলতে কতটা পেরেছে জানি না। তার এত সব ভেল্কিবাজি কাণ্ড কারখানা যে ‘লোভ’ নামক রিপুকে উস্কে দিতে পেরেছে অনেক মানুষের মধ্যে, সন্দেহ নেই। লোভ কি শুধু সাধারণ ক্রেতা বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সরবারহকারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল? সমাজের নামী-দামী ব্যক্তিদের মধ্যে, সরকারের যে সংস্থাগুলো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এই অতি-লোভ, অতি অবাস্তব সেই উনবিংশ শতাব্দীর চার্লস পঞ্জি-মার্কা ব্যবসার মডেল সম্পর্কে উদাসীনতা দেখাল। যারা মাসিক বেতন হিসাবে পাঁচ লাখ বা ততোধিক টাকা উপার্জনে কোম্পানিটিতে যোগ দিল, কাজ করল এবং ব্রান্ড মূল্য বাড়াল তাদের মধ্যে লোভ নামের লালসা কাজ করেনি? ইভ্যালির ব্যবসায়ী মডেল -সন্দেহজনক ও টেকসই কিনা এ নিয়ে ২০২০ সালেই দু একটি পত্রিকা (প্রথম আলো) প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। বানিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকলের এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকেরও কিছুটা টনক নড়েছিল। কাজও হয়েছিল। ইভ্যালির ব্যাংক একাউন্ট সাময়িক স্থগিত করা হয়েছিল।
সেটা হয়েছিল ক্ষণকালের জন্য। ইভ্যালি ও তার মূলকর্তা রাসেল শোধরায়নি। ব্যাংক একাউন্ট আবার খুলে দেবার পর নব উদ্যমে মাঠে নেমে পড়লেন আরও বেশি মানুষকে ঠকাতে। প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের সঙ্গে সখ্যতা ও মেলামেশা বাড়িয়ে দিলেন। তাহসান, ফারিয়া, মিথিলা এমন সব তারকাদের আলোর ঝলকানিতে ইভ্যালিকে আলোকিত করলেন। মিডিয়াতে বিজ্ঞাপনের বাহার ও প্রচার আরও বাড়িয়ে দিলেন। মাছের তেলে তিনি মাছ ভাজতে শুরু করলেন। এতসব প্রচারের জাদুকরি শক্তির টানে ইভ্যালির জালে আটকা পড়লো আরও গ্রাহক। তারা কি শুধুই লোভে পড়ে এসেছিল? এদের অনেকেই ইভ্যালির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সমাজের তথাকথিত সাধুজনের কথা বিশ্বাস করেছিল।
আজ সেসব সাধুজন তথাকথিত ভদ্রলোকেরা সমাজের মধ্যে প্রভাব সৃষ্টিকর্তারা সটকে পড়ছেন। ইভ্যালি যে বাংলাদেশের আপামর মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষগুলো থেকে এমন প্রত্যারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে আমাদের ভদ্রজনের পেছনে খরচ করলো তার কি হবে? এরা কি প্রতারিত ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইবে? এরা কি সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে সংগ্রহ করা অর্থে যে বেতন নিয়েছে, জাঁকজমক অনুষ্ঠানে কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে ও সে সূত্রে নিজেরাও আয় করেছে তা ক্ষমা চেয়ে ফেরত দেবে? এমন একজন বিবেকবান ব্যক্তি কি এদের মধ্যে আছে? ইভ্যালি যে তার সাধারণ ক্রেতাদের কষ্টার্জিত, অতি কষ্টে জমিয়ে রাখা বা জমি-জমা বিক্রি ও ধার করে অর্থ এনে তার ভেল্কিবাজীর বাক্সে জমা করেছে, অতঃপর সমাজের তথাকথিত পৃষ্টপোষকদের (রাজনীতি থেকে প্রশাসন, সেনা থেকে তারকা জগৎ ও মিডিয়া) পেছনে ফেলেছে এক অলীক ও ভঙ্গুর ব্রান্ড ভ্যালু সৃষ্টি করার জন্য তার কি কোন প্রতিকার হবে? হবে না জেনেই প্রশ্নটা করলাম। জানি বিচারের হাত বড় লম্বা। তবে নেপথ্যের এদের ধরবার মত লম্বা বলে মনে হয় না। আমরা জানি এক ডেসটিনির পরে এসেছে আরেক যুবক। এরপর এলো ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা আরও কত কি? আজ তারা ধরাশায়ী বটে। তবে এদের মতই আরও অনেকে অন্য নামে নতুন ধান্ধা নিয়ে অর্বিভূত হবে। প্রতারণা চলেছে, চলছে ও চলবে।
ফরিদ হোসেন: উপদেষ্টা সম্পাদক, ইউএনবি
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবি’র নয়)
আরও পড়ুন: ইভ্যালির সিইও ও চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার