ইউএনবির সাথে আলাপকালে কয়েকজন রেস্তোরাঁ কর্মী ও তাদের নেতারা জানান, বেশিরভাগ হোটেল মালিকই তাদের মজুরি ও পাওনা পরিশোধ না করেই দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন। এর ফলে দেশব্যাপী লকডাউন এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম প্রায় বন্ধ থাকার মধ্যেই দুর্দশায় পড়েছেন তারা।
এসকল শ্রমিকরা চান যে, তাদের নিয়োগকর্তারা চলমান এ সংকটের সময়ে তাদের পাশে দাঁড়াবেন এবং পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকতে সহায়তা করবেন।
বকেয়া বেতন পরিশোধের জন্য হোটেল মালিকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে, তাদের জন্য খাদ্য রেশন চালু করার কথা বলছেন শ্রমিকরা। এছাড়া দুর্দশা লাঘব করতে এই খাতেও কিছু অনুদান দেয়ার আহ্বান জানান তারা।
রাজধানীর মৌচাকের একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করা ভারা মিয়া ইউএনবিকে বলেন, ‘গত ২৪ মার্চ অল্প কিছু টাকা দিয়ে হোটেল বন্ধ করে দেন আমাদের মালিক। এখন আমার আয়ের কোনো উৎস নেই, কিন্তু পরিবারের চার সদস্যের জন্য খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হয় আমার। এখন ভিক্ষা করা ছাড়া আমার কাছে আর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এখন সেটিও সম্ভব নয়, কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এখন মানুষকে বাইরে বের হতে দিচ্ছেন না।’
তিনি বলেন, ‘আমি আমার নিয়োগকর্তাকে পাওনা পরিশোধের জন্য ফোন করেছিলাম, কিন্তু রেস্তোরাঁর ভাড়া পরিশোধ করা নিয়ে চাপে থাকার কথা জানান তিনি। আমি এখন জানিনা কীভাবে নিজের পরিবারের দেখভাল করব এবং তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করব।’
শহরের রামপুরা বাজারের একটি খাবার হোটেলের শ্রমিক আবুল কালাম বলেন, ‘তাদের মালিকরা আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, খাবারের দোকানটি খোলা রাখবেন। কিন্তু ২৭ মার্চ সেটি বন্ধ হয়ে যায়। করোনা আতংকের কারণে আমি এবং আমার কয়েকজন সহকর্মী এখন রেস্তোরাঁর ভেতরেই থাকি। আমাদের মালিকই আমাদের খাবার সরবরাহ করেন। আমাদের বেতন আংশিক দিয়েছেন, যা আমরা বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। এই অল্প টাকায় প্রতিদিনের খরচ মেটাতে মানাত্মক সমস্যায় পড়ছে আমার পরিবার।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওয়েটার হিসাবে কাজ করায় আমি গ্রাহকদের কাছ থেকে টিপস পেতাম, যা আমার বেতনের চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু এখন আমার কাছে কোনো টাকা নেই। আমাদের দুর্দশা লাঘবে মালিক এবং সরকার উভয়েরই এগিয়ে আসা উচিত।’
বাংরাদেশ হোটেল রেস্তোরাঁ শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন জানান, বেশিরভাগ হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিকই তাদের শ্রমিকদের বেতন ও বকেয়া মজুরি পরিশোধ না করে দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন। এর ফলে গুরুতর সমস্যায় পড়েছেন শ্রমিকরা।
তিনি বলেন, রাজধানীতে কমপক্ষে ১০ হাজার হোটেল-রেস্তোরাঁ রয়েছে এবং ওয়েটার, বাবুর্চিসহ প্রায় ২ লাখ শ্রমিক রয়েছেন যারা ন্যূনতম মজুরি নিয়ে কাজ করেন। এর মধ্যে যারা ওয়েটার হিসেবে কাজ করেন তারা নির্ভর করেন গ্রাহকের টিপসের ওপর। কিন্তু এখন চাকরি আর মজুরি ছাড়া অমানবিক জীবনযাপন করছেন এসব শ্রমিকরা।
আনোয়ার বলেন, গণপরিবহন বন্ধ হওয়ার আগে কিছু শ্রমিক গ্রামে ফিরে যেতে পারলেও, অনেকেই পরিবার নিয়ে এখন ঢাকায় আটকে রয়েছেন।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কর্মীদের পাওনা পরিশোধ করতে এবং মজুরি দেয়ার জন্য হোটেল মালিকদের আহ্বান জানাতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
এসকল শ্রমিকদের জন্য খাদ্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা এবং অনুদান দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান আনোয়ার, যাতে পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন এ খাতের নিম্ন আয়ের বিপুল সংখ্যক শ্রমিক।
বাংলাদেশ হোটেল-রেস্তোরাঁ, মিষ্টান্ন এবং বেকারি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আক্তারুজ্জামান বলেন, কর্মচারীদের বেতন না দিয়ে হোটেল বন্ধ করে শ্রম আইন লঙ্ঘন করেছেন মালিকরা।
তিনি জানান, শ্রম আইন অনুসারে, ‘যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মালিকদের উচিত তাদের কর্মীদের বেতন পরিশাধ করে দেয়া। মালিকরা বছর জুড়েই লাভ করছেন। তদের দায়িত্ব কর্মীদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের মজুরি পরিশোধ করা। এক্ষেত্রে সরকারকে শ্রম আইন কার্যকর করতে হবে।’
এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য গত ২৫ মার্চ কারখানা ও স্থাপনা পরিদর্শন অধিদপ্তরর প্রধান পরিদর্শকের কাছে একটি আবেদন জমা দেয়ার কথাও জানান আক্তার।
ইউএনবির সাথে আলাপকালে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব রেজাউল করিম সরকার রবিন বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে সব কিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই খাত চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে। হোটেল রেস্তোরাঁ খাতের সাথে সরাসরি জড়িত রয়েছেন প্রায় ১২ লাখ শ্রমিক। এছাড়া মাছ ব্যবসায়ী, মাংস ব্যবসায়ী, সবজি বিক্রেতা এবং মুদি ব্যবসায়ীসহ এক কোটিরও বেশি মানুষ এই খাতের সাথে জড়িত। সব খাবার হোটেল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন এসকল মানুষ।’
যথেষ্ট না হলেও বেশিরভাগ হোটেল মালিকরাই তাদের শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করেছেন দাবি করে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আমাদের কর্মীদের যতটা সম্ভব সাহায্য করছি। তবে আমরাও চাপে আছি। হোটেলগুলো বন্ধ থাকা সত্ত্বেও এগুলোর জন্য বিপুল পরিমাণ ভাড়া ও অন্যান্য বিল পরিশোধ করতে হবে। হোটেলগুলো বন্ধ থাকলে আমরা শ্রমিকদের মজুরি দিতে পারবো না। কেবলমাত্র সরকারই পারে আমাদের এসকল দরিদ্র কর্মীদের খাদ্য সরবরাহ করতে এবং কিছু অনুদান দিয়ে তাদের সহায়তা করতে।’