করোনাভাইরাস মহামারির এ সময়ে সারাবিশ্ব সংকটময় এক সময় পার করছে। কোভিড-১৯ সংকট মোকাবিলায় কানাডার ভূমিকা এবং অন্যান্য মানবিক চ্যালেঞ্জসমূহ নিয়ে একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কানাডার আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী ক্যারিনা গোল্ড। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন ইউএনবির ডিরেক্টর নাহার খান। পাঠকদের জন্য তার নির্বাচিত অংশ তুলে ধরা হলো-
নাহার খানঃ মাননীয় মন্ত্রী, ইউএনবির পক্ষ থেকে আমি আপনাকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই।
কারিনা গোল্ড: আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। কথা বলতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত।
নাহার খান: মাননীয় মন্ত্রী, কোভিড-১৯ থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কানাডা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও উদার ভুমিকা পালন করছে এবং আন্তর্জাতিক সাহায্যের ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে নেতৃত্বে প্রদান করছে। আপনি কী বিশ্বব্যাপী এ পদক্ষেপগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমাদেরকে জানাবেন?
কারিনা গোল্ড: হ্যাঁ, অবশ্যই। এপ্রিলের শুরুতে, কোভিড-১৯ সংকট মোকাবিলায় মানবিক প্রয়োজনের পাশাপাশি একটি কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরির জন্য প্রাথমিকভাবে ১৫৯.৫ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করার ঘোষণা দেয় কানাডা। কারণ আমরা জানি যে, বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলোর মধ্যে এখন অন্যতম হল একটি ভ্যাকসিন তৈরি করা এবং সেটির কার্যকর ব্যবহার। এজন্য আমাদের বরাদ্দকৃত ১৫৯.৫ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৮৪.৫ মিলিয়ন ডলার মানবিক সহায়তার জন্য ব্যবহার করা হবে যা মূলত জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির মাধ্যমে প্রদান করা হয়েছে। এরপর আমরা মহামারির প্রস্তুতি হিসেবে ভ্যাকসিনের জন্য বৈশ্বিক গবেষণা এবং সেটি তৈরির সমন্বয় কাজের জন্য আরও ৪০ মিলিয়ন ডলার অর্থ বরাদ্দ করেছি। এছাড়াও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিবেচনায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাহায্যের অনুরোধের প্রেক্ষিতে আমরা আরও ৩০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দিয়েছি। এসব সহায়তা আমরা আমাদের বিদ্যমান মানবিক উন্নয়ন তহবিলের পাশাপাশি করছি, যা আমরা সাধারণভাবে করে থাকি এবং আমরা এমন অঞ্চলগুলো খুঁজছি যেখানে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সত্যিকার অর্থেই সহায়তা প্রয়োজন। আমরা এটিও মনে করছি যে, আমাদের প্রচুর উন্নয়ন এবং মানবিক কাজের ওপর জোর দেয়া গুরুত্বপূর্ণ কারণ কোভিড-১৯ সংকট দেখা দিয়েছে মানে এমন নয় যে আমাদের পূর্ববর্তী অনেক সমস্যা বা চ্যালেঞ্জগুলো শেষ হয়ে গেছে। আসলে এসব সমস্যা আরও বেশি উদ্বেগজনক। তাই গত মাসে গ্যাভিতে কানাডার অনুদান দেয়ার ঘোষণা দিতে পেরে আমি সত্যিই অনেক আনন্দিত, যেটি আন্তর্জাতিক টিকা জোট। যারা প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে কয়েক লাখ শিশুকে টাইফয়েড, ডিপথেরিয়ার মতো রোগের বিরুদ্ধে টিকা দিয়ে থাকে। এর পাশাপাশি আমরা বিশ্বব্যাপী পোলিও নির্মূলে নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগেও সহায়তা করছি। কারণ আমরা বিশ্বজুড়ে পোলিও নির্মূলের খুব কাছাকাছি রয়েছি এটি নিশ্চিত করার জন্য যে, ভ্যাকসিনের অভাবে যাতে পোলিওর মতো রোগের পুনরুত্থান না হয়।
নাহার খান: অবশ্যই। সম্প্রতি ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত গ্যাভি সম্মেলনে আমরা বিশ্বের অনেক নেতাকে একসাথে জড়ো হতে দেখেছি এবং বলার অপেক্ষা রাখে না যে এটি একটি সফল আলোচনা ছিল।
কারিনা গোল্ড: হ্যাঁ, আপনি এবং আমি এখন যেমন ভার্চুয়ালি আলোচনা করছি, বিশ্ব নেতারাও ঠিক তাই করছেন। ভ্যাকসিন বিষয়ক শীর্ষ সম্মেলনটি দেখে আমরা সবাই সত্যিই উৎসাহিত হয়েছি যেটি ৪ জুন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমরা সন্তুষ্ট যে ২০৩০ সালের এজেন্ডা ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে এবং সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্ব নেতাদের সাথে প্রধানমন্ত্রী এতে অংশ নিতে পারেন।
নাহার খান: মাননীয় মন্ত্রী, পাঁচ দশক আগে বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকে কানাডা এবং বাংলাদেশ একে অপরের সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এটি একটি উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে সহযোগিতার দুর্দান্ত দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হয়। কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় বাংলাদেশের জন্য কানাডার নির্দিষ্ট উদ্যোগগুলো কী?
কারিনা গোল্ড: এটি সত্যিই একটি ভালো প্রশ্ন। যেমনটি আপনি বলেছেন, এটি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ কারণ কানাডা এবং বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক এবং গভীর বন্ধুত্ব রয়েছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। আমি কানাডার যে ৩০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দের কথা বলেছি সেগুলো দ্বিপাক্ষীক সহায়তার জন্য। এর মধ্যে ২ মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশকে দেয়া হবে। এর মধ্যে ৫ লাখ ডলার কক্সবাজার এবং সেখানকার স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও এর আশে পাশের এলাকার উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের গ্রামীন উন্নয়ন কমিটির সাথে আমাদের চুক্তি সম্পাদনের জন্য এবং দেড় মিলিয়ন ডলার দেয়া হবে বাংরাদেশের আন্তর্জাতিক ডায়রিয়া গবেষণা কেন্দ্রকে। কারণ আমরা জানি যে, করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলটি হলো পর্যাপ্ত পরীক্ষা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করা। কিন্তু এর জন্য পরীক্ষাগারের সক্ষমতাও থাকা প্রয়োজন। সুতরাং আমাদের বিদ্যমান নানা প্রকল্পের পাশাপাশি, আমরা সারাদেশে পরীক্ষা এবং পরীক্ষাগার উভয়েরই সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা ও সহায়তা করার জন্য প্রাথমিকভাবে কিছু অর্থ সরবরাহ করেছি। কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোর জন্য নির্দিষ্টভাবে কিছু অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে।
নাহার খান:মাননীয় মন্ত্রী, রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট শুরুর পর থেকেই কানাডা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের পাশে রয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য কি আপনাদের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা রয়েছে? রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে। রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানের বিষয়ে কানাডার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
কারিনা গোল্ড: রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ায় এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অসাধারণ প্রচেষ্টার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। অবশ্যই আমরা এ পরিস্থিতি নিয়ে ভাবছি এবং কানাডা আইসিজে’তে গাম্বিয়াকে এ বিষয়ে সমর্থনও দিয়েছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সেটি স্বীকার করে কানাডার সংসদ সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। সুতরাং সব পক্ষের সাথে আলোচনার মাধ্যমে এই সংকটের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান করে রোহিঙ্গাদেরকে তাদের প্রাপ্য অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যেমনটি আপনি উল্লেখ করেছেন, আমরা শুরু থেকেই পাশে ছিলাম। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য মানবিক সহায়তা তহবিলে কানাডা প্রায় ৮৮ মিলিয়ন ডলার প্রদান করেছে এবং কক্সবাজারের স্থানীয় সম্প্রদায়ের অসহায় মানুষকেও সহায়তা করা জরুরি বলে বিবেচনায় নিয়ে তাদের জন্যও আমরা প্রায় ৮২ মিলিয়ন ডলার প্রদান করেছি। আমরা এ সংকটের একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং কানাডা সবসময় রোহিঙ্গা জনগণের মানবাধিকারের নিশ্চিতের জন্য বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যাতে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন অব্যাহত রাখে সেটিও নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে দৃঢ় ভূমিকা পালন করবে কানাডা। আমরা বিশ্বাস করি, রোহিঙ্গারা শান্তি এবং নিরাপত্তার সাথে বাস করবে।
নাহার খান: মাননীয় মন্ত্রী, ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশ’র সাথে আন্তরিকভাবে কথা বলার জন্য এবং কানাডার কাছ থেকে বাংলাদেশ যে অবিরাম সমর্থন পাচ্ছে সেজন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি। শুভেচ্ছা রইল।
কারিনা গোল্ড: ধন্যবাদ।