বাগেরহাটে গত দেড় বছরে তিন সহস্রাধিক অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। বাল্যবিয়ের শিকার এসব কিশোরী মেয়েরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। তারা পড়ালেখা বন্ধ করে এখন স্বামীর সংসার করছে। এদিকে, বাল্যবিবাহ রোধ করতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সচেতন হওয়া জরুরি বলে জেলা প্রশাসক মনে করছে।

শিক্ষা বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জেলায় করোনাকালীন সময়ে তিন হাজার ১৭৮ জন শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই সময়ে প্রায় ৪০০ বাল্যবিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদানের সময় অনেক মা ও শিশু মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়ে।

করোনাকালে বাল্যবিয়ের শিকার নীলাঞ্জনা (ছদ্মনাম) বাগেরহাট শহরের বাসাবাটি রহমানিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী। গত বছর নভেম্বর মাসে তার বিয়ে হয়। অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা এবং লেখাপড়া নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে মা-বাবা সিদ্ধান্ত নিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে সে ওই বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণির ছাত্রী। তার বাবা পেশায় একজন হকার।

বিয়ের তিন মাসের মধ্যে স্বামীকে ডিভোর্স দেয়া নবম শ্রেণির ছাত্রী নীলাঞ্জনা জানায়, বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তার মধ্যে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। পরিবারে অভাব অনটন মা-বাবাকে ভাবিয়ে তোলে। পরিবারের সিদ্ধান্তে সে বিয়েতে রাজি হয়। বিয়ের পর সে স্বামীর সংসারে চলে যায়। কিছুদিন পর স্বামী তার উপর নির্যাতন চালাতে থাকে। নির্যাতন সইতে না পেরে সে বাবার বাড়ি চলে আসে। বিয়ের তিন মাসের মধ্যে সে তার স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছে। এখন সে আবারও পড়ালেখা করতে চায়। পড়ালেখা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় নীলাঞ্জনা।

পড়ুন: বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সাংসদদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ: স্পিকার

শহরের জাহানাবাদ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী সুমনার (ছদ্মনাম) বিয়ে হয় করোনার শুরুর দিকে। তার সম্মতিতেই বিয়ে হয়। সুমনা শ্বশুরবাড়িতে সংসারের সব কাজই করছে। তার স্বামী ট্রাকচালকের সহকারী। কিন্তু সংসার করলেও পড়ালেখা ছাড়েনি। সে এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী।

একই বিদ্যালয়ের এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী অপর শিক্ষার্থীর দুই মাস আগে বিয়ে হয়েছে। তবে তার এখনো স্বামীর সংসারে যাওয়া হয়নি। ভালো খবর হচ্ছে বিদ্যালয়ে গিয়ে তাদের দু’জনেরই দেখা মিলেছে। বাল্যবিয়ের শিকার হয়েও তারা পড়ালেখা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়।

বাসাবাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির দুই ছাত্রী জানায়, তাদেরও বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। কিন্তু তারা এতে সায় দেয়নি এবং বাল্যবিয়ে বন্ধের চেষ্টা করে সফল হয়েছে। 

বাগেরহাট বাসাবাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির এক ছাত্রীর মা (আকলিমা বেগম) জানান, করোনায় বিদ্যালয় বন্ধ এবং পরিবারের উপার্জন না থাকায় মেয়েকে নিয়ে তারা দুশ্চিন্তায় পরেছিল। একারণে অটোচালক এক ছেলের সাথে এক বছর আগে মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। তার মেয়ে এখন অন্তঃসত্তা।

ওই বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির এক ছাত্রীর বাবা চা দোকানদারা সগীর মুন্সি ও মা আলেয়া বেগম জানান, মেয়ে পড়ালেখা করে একটি চাকরি করবে এমন স্বপ্ন ছিল তাদের। কিন্তু করোনায় সব স্বপ্ন ভেঙে গেছে। অনেকটা বাধ্য হয়ে অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ের বিয়ে দিয়েছি।

জেলার বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে, প্রায় দেড় বছর পর বিদ্যালয় খোলার পর তারা এসে দেখে তাদের দীর্ঘদিনে বেশ কয়েকজন সহপাঠি বিদ্যালয়ে আসছে না। খোঁজ নিয়ে তারা জানতে পারে অনুপস্থিত ওই সব সহপাঠিদের বিয়ে হয়ে গেছে।

পড়ুন: কুড়িগ্রামে এক বিদ্যালয়ে ৮৫ শিক্ষার্থীর বাল্যবিয়ে!

জানা গেছে, করোনা মহামারিতে দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিবাবকদের মধ্যে অনেকটা অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত পরিবারের মধ্যে হতাশা বিরাজ করতে থাকে। এ অবস্থায় ওই সব শিক্ষার্থীদের পরিবারের সামাজিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা তাদেরকে অনেকাংশে ভাবিয়ে তোলে।

পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ওই সব পরিবার তাদের কিশোরী মেয়েদেরকে বিয়ে দিয়ে দেন। ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল খোলার পর শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির কারণ জানতে একে একে এই বাল্যবিয়ের তথ্য বের হতে থাকে।

এরপর শিক্ষা বিভাগের তোড়জোড় শুর হয়। জেলা শিক্ষা বিভাগের তালিকায় করোনাকালে বাগেরহাটে বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে তিন হাজার ১৭৮ জন মেয়ে। পঞ্চম থেকে শুরু করে দশম শ্রেণির মেয়েরা এখানে বেশি বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে।

বাগেরহাট জাহানাবাদ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক উত্তম কুমার পাল জানান, তার বিদ্যালয়ের পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১৮ ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়ে গেছে। এর মধ্যে বিবাহিত সাত জন ছাত্রী বিদ্যালয়ে আসছে এবং পড়ালেখা করছে। 

বাগেরহাট বহুমুখী কলেজিয়েট স্কুলের অধ্যক্ষ ফারহানা আক্তার জানান, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সপ্তম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ২২ জন শিক্ষার্থীর বাল্যবিয়ে হয়ে গেছে।

বাগেরহাট বাসাবাটি রহমানিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সালাম জানান, তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১১ শিক্ষার্থীর বাল্যবিয়ে হয়েছে।

পড়ুন: করোনা: কুড়িগ্রামে ঝরে পড়েছে ৫০ হাজার শিশু, বাল্যবিয়ের শিকার বালিকারা

বাগেরহাট জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান জানান, ঊর্ধ্বতন কৃর্তপক্ষের নির্দেশ পেয়ে জেলায় বাল্যবিবাহের শিকার শিক্ষার্থীদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১৮ মার্চের পূর্ব থেকে চলতি বছরের ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাগেরহাট জেলায় মোট বাল্যবিয়ে সংখ্যা তিন হাজার ১৭৮ জন। এর মধ্যে বাগেরহাট সদর উপজেলায় ৪৯৭, ফকিরহাটে ৩৯১, মোল্লাহাটে ৩৪৪, চিতলমারীতে ৪০৭, কচুয়ায় ৫১৬, রামপালে ২৩৭, মোংলায় ২১৮, মোড়েলগঞ্জে ৩৫৫ ও শরণখোলা উপজেলায় ২১৩টি।

বাগেরহাট জেলা বাল্যবিয়ে নিরোধ কমিটির সদস্য ও নারী উন্নয়ন ফোরামের খুলনা-বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক সম্বনয়কারি রিজিয়া পারভীন জানান, বাল্যবিয়ে বন্ধ করার ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বড় ভূমিকা রাখতে হবে।

বাগেরহাট সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. প্রদীপ কুমার বকসী জানান, অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ এবং সন্তান জন্ম দেয়ার সময় অনেক মা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায়। এমনকি মায়ের সাথে শিশুর মৃত্যুও হতে পারে। অপরিণত বয়সে বিয়ে হলে কোন অবস্থাতেই মাতৃমৃত্যুর সংখ্যা ঠেকানো যাবে না। 

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, ‘বিদ্যালয় খোলার পর জানাতে পারি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাল্যবিয়ে হয়ে গেছে। যারা বাল্যবিয়ের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোন অবস্থাতেই অবৈধ জন্মসনদ যাতে ইস্যু করা না হয় এজন্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দেড় বছরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় ৪০০ বাল্যবিয়ে বন্ধ করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বাল্যবিবাহ রোধ করতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে সচেতন হতে হবে। জেলা এবং উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ছাত্রীদের বোঝানো হচ্ছে তারা যাতে বাল্যবিবাহে রাজি না হয়। একই সাথে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। কোন অবস্থাতেই এ জেলায় বাল্যবিবাহ হতে দেয়া হবে না।’

তবে দরিদ্রতা ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে পরিবার তাদের মেয়েদেরকে বাল্যবিয়ে দিয়েছে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।

পড়ুন: আখাউড়ায় ইউএনও’র হস্তক্ষেপে বাল্যবিয়ে বন্ধ