বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) এবং ৪০টিরও বেশি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) এখন রোহিঙ্গাদের কৃষি, মাছ চাষ, সেলাই কাজ, হাঁস-মুরগি পালন এবং অনুপ্রেরণামূলক প্রশিক্ষণ দিতে ভাসানচরে কাজ করে যাচ্ছে।
সম্প্রতি এক সফরে ভাসানচরে গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ রোহিঙ্গা পুরুষ এবং নারী উভয়ই বরাদ্দ হিসেবে পাওয়া সহায়তার পাশাপাশি অর্থ উপার্জনের চেষ্টায় ভাসানচরে বিভিন্ন দোকান চালাচ্ছেন।
আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্পের (ভাসানচর) প্রকল্প পরিচালক কমডোর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী ইউএনবিকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের যদি কৃষি কাজ, মাছ চাষ, সেলাই, হাঁস-মুরগির পালন এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজে জড়িত করা যায় তবে তারা বড় ধরনের অপরাধ থেকে দূরে থাকবে।’
আরও পড়ুন: রোহিঙ্গা সঙ্কটের স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় ইইউ
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে পুরো বিশ্ব সম্প্রদায়ের এক হওয়া উচিত: ইইউ
বর্তমানে কিছু পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে এবং এনজিওগুলো তাদের সম্পূর্ণ প্রকল্প জমা দিচ্ছে এবং আশা করা যাচ্ছে আগামী এক মাসের মধ্যে এগুলো আরও ভালো অবস্থানে যাবে, বলেন তিনি।
এরইমধ্যে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কারণে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
ভাসানচরের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিদর্শন গিয়ে বিআরডিবির যুগ্ম পরিচালক সুকুমার চন্দ্র দাস বলেন, এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি এলাকায় তারা ৭৫০ রোহিঙ্গাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
তাদের আগ্রহের বিষয়গুলোর মধ্যে মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, সেলাই মেশিন চালানো, কৃষি, সবজি চাষ ও হস্তশিল্প অন্যতম।
সুকুমার চন্দ্র বলেন, প্রশিক্ষণ নেয়া রোহিঙ্গাদের উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে প্রকল্প গ্রহণের বিষয়টি বিবেচনাধীন রয়েছে।
আরও পড়ুন: রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ইইউ’র অনুদানকে স্বাগত জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর
দেশীয় ফ্যাশন হাউস কে ক্র্যাফট ভাসানচরে রোহিঙ্গা নারীদের উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়ানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
প্রাথমিকভাবে ১৫০ রোহিঙ্গা নারীকে তিন মাস ধরে কাটিং, সেলাই, মুদ্রণ, নকশা, ব্লক প্রিন্টিং এবং মেশিনে এমব্রয়ডারি কাজের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কে ক্রাফট।
ইউএনবির সাথে আলাপকালে বিআরডিবি প্রশিক্ষণ ক্লাসের একজন রোহিঙ্গা নারী প্রশিক্ষণার্থী জানান তাদের সেলাইয়ের ওপর পাঁচ দিনের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। ‘আমরা এখানে ৪০ জন নারী প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। কক্সবাজারে ক্যাম্পগুলোতে এই সুযোগ ছিল না।’
তিনি বলেন, তারা প্রথমে তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য কাপড় সেলাই করবেন এবং তারা যখন মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করতে পুরোপুরি দক্ষ হয়ে উঠবেন তখন তারা এগুলো বিক্রি করতে পারবেন। ‘এগুলো করে আমরা যদি কিছুটা অর্থ উপার্জন করতে পারি তবে তা আমাদের জন্য ভালো হবে।’
আরও পড়ুন: রোহিঙ্গা ইস্যুতে বড় দেশগুলোর সিদ্ধান্ত কৌশলগত: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ফিরে দেখা ২০২০: রোহিঙ্গাদের জন্য যন্ত্রণার আরও এক বছর
কমোডর মামুন বলেন, ভাসানচরে কোনো স্থানীয় জনগোষ্ঠী না থাকায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে গেলে রোহিঙ্গারা কোনো বাধার মুখে পড়বেন না।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় যে উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে তা হলো তাদের সন্তানদের ভবিষ্যত। ভাসানচরে শিশুরা অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাচ্ছে বলেও জানান কমোডর মামুন।
অ্যালায়েন্স ফর কো-অপারেশন অ্যান্ড লিগ্যাল এইড বাংলাদেশের (এসিএলএবি) কমিউনিটি এনগেজমেন্ট কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল-মামুন ইউএনবিকে বলেন, তারা রোহিঙ্গা শিশুদের সকাল ও বিকাল দুই শিফটে অনানুষ্ঠানিকভাবে ইংরেজি ও বার্মিজ ভাষা শেখাচ্ছেন।
এমনই একটি শিখন কেন্দ্রের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা আমাদের নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থ ব্যয় করছি। শিগগিরই আমরা অনুদান পাব বলে আশা করছি।’
কমোডর মামুন বলেন, রোহিঙ্গারা নিরাপদে মিয়ানমারে তাদের নিজ বাড়িতে ফিরে যেতে চান তবে ফিরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তারা এখানে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতে পারছেন।
বাংলাদেশ বলছে, বিভিন্ন কারণে নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অস্থায়ীভাবে জায়গা দিতে গিয়ে সরকারকে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সে জন্য সরকার এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা করতে বাধ্য হয়েছে।
আরও পড়ুন: বছরের ২য় প্রান্তিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আশাবাদী বাংলাদেশ
বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গারা বিবেচিত হচ্ছেন বাংলাদেশি হিসাবে: সৌদি দূত
রোহিঙ্গাদের ফেরাতে মিয়ানমার রাজি থাকলেও আন্তরিক নয়: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
এরই পরিপ্রেক্ষিতে, প্রথম ধাপে গত বছরের ৪ ডিসেম্বর ১,৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে এবং ২৯ ডিসেম্বর দ্বিতীয় ধাপে ১,৮০৪ জন রোহিঙ্গাকে কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়।
কমোডর মামুন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের বরাতে বলেন, পরবর্তী ধাপে ভাসানচরে আসতে আগ্রহী আরও অনেক রোহিঙ্গাকে শিগগিরই নিয়ে আসা হবে।
এখনও পর্যন্ত সাত হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় ভাসানচরে স্থানান্তরিত হয়েছেন এবং সর্বশেষ গত ২৮-২৯ জানুয়ারি তাদের স্থানান্তর করা হয়েছিল।
এর আগে, ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। পরে ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ সম্পর্কিত একটি নথিতে স্বাক্ষর করে, যা রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সাহায্য করবে বলে মনে করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ বলছে, মিয়ানমার সরকারের ওপর রোহিঙ্গাদের আস্থা নেই এবং তাদের মধ্যে আস্থা বাড়াতে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ।
রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে দ্বিপক্ষীয়, বহুপক্ষীয়, ত্রিপক্ষীয় এবং বিচার ব্যবস্থাসহ একাধিক মাধ্যমে বাংলাদেশ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
মিয়ানমারের বন্ধুরাষ্ট্র জাপান, চীন, রাশিয়া এবং আশিয়ানভুক্ত দেশগুলো থেকে বেসামরিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ।