অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, চলমান স্থবিরতা অনানুষ্ঠানিক খাতে নিযুক্ত লাখ লাখ মানুষের জীবিকার ওপর ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলবে, যা অর্থনীতির ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করবে।
স্বল্প আয়ের মানুষ, বিশেষত দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ, রিকশা চালক, পরিবহন শ্রমিক, হকার, রেস্তোরাঁ ও দোকানের কর্মচারী এবং নির্মাণ শ্রমিকরা এরই মধ্যে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
করোনভাইরাসের কারণে দেশের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে দরিদ্রদের নগদ প্রণোদনা প্রদান এবং সঠিকভাবে ত্রাণ বিতরণ ও প্রণোদনা প্যাকেজগুলো সদ্ব্যবহারে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে, প্রায় ৬০ দশমিক ৮ মিলিয়ন মানুষ বিভিন্নভাবে কর্মসংস্থান বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন, যা আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থানের ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ।
ইউএনবির সাথে আলাপকালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারকে প্রথমে সবার জন্য খাবার নিশ্চিত করতে হবে। জীবন বাঁচানোটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষুধার কারণে মৃত্যু রোধ করতে হবে এবং সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে।’
প্রয়োজন অনুযায়ী সরকারকে মানুষের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেয়ার পরামর্শ দিয়ে বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘দরিদ্র মানুষের সহায়তা বৃদ্ধি করতে হবে। এ সংকটের মধ্যে আমরা অনেক জায়গায় দেখতে পাচ্ছি যে ত্রাণসামগ্রী অবৈধভাবে গুদামজাত করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নজরদারি বৃদ্ধি করে যথযথভাবে ত্রাণ বিতরণ করতে হবে।’
এদিকে, অর্থনীতির জন্য জরুরি ও পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘খাদ্য ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। তারপরে, অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।’
সরকারের প্রণোদন প্যাকেজকে স্বাগত জানিয়ে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অবশ্যই কঠোরভাবে নজরদারি করতে হবে যাতে কেউ পরিস্থিতির সুযোগ নিতে না পারে। ঋণখেলাপি মোকাবিলায় সুশাসন জরুরি।’
সরকারকে ৭৫ দশমিক ৭ মিলিয়ন নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য মাসিক ৮ হাজার টাকা নগদ বরাদ্দ দেয়ার আহ্বান জানিয়ে অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর বলেন, ‘করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে ভবিষ্যতে অর্থনীতি ও প্রবৃদ্ধি উভয়ই হ্রাস পাবে। সুতরাং, সমস্যাটি মোকাবিলায় শ্রমিক ও উদ্যোক্তাদের গতিশীল করতে হবে।’
আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থানের মধ্যে ১৪ মিলিয়ন মানুষ মাসিক ভিত্তিতে বেতন পায় এবং ১০ মিলিয়ন দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ। পাশাপাশি, ২৭ মিলিয়ন মানুষ আত্মকর্মসংস্থান- যেমন হকার, ফুটপাতের বিক্রেতা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। সে হিসেবে দেশের শ্রমশক্তির বড় অংশ ৩৭ মিলিয়ন (আত্মকর্মসংস্থান ও দিনে এনে দিন খাওয়া মানুষ) এখন আপাতত কর্মহীন হয়ে পড়েছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ১০ মিলিয়ন দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছেন এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের ২৭ মিলিয়ন ধীরে ধীরে কর্মসংস্থান এবং ক্রয় ক্ষমতা হারাচ্ছেন।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ড. এমএ রাজ্জাক বলেন, সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হওয়ায় কৃষকরা তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারছেন না। এ অবস্থায় বাজারে কৃষিজাত পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
জীবন ও জীবিকা বাঁচাতে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত ক্ষতিগ্রস্ত বা দরিদ্রদের নগদ প্রণোদনা প্রদান। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জীবন বাঁচানো মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।’
এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। চিকিৎসক, নার্স এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা দিতে হবে এবং হাসপাতালে সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে।’
‘মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৮৫-৯০ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। সব মিলিয়ে ৫০ মিলিয়ন মানুষ এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তাদের নগদ প্রণোদনা দেয়া উচিত,’ যোগ করেন অর্থনীতিবিদ ড. রাজ্জাক।