উদ্বোধনের ১১ দিনের মাথায় গত ২ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনার আটটি ঘরের দেয়াল ও মেঝেতে ফাটল দেখা দেয়ায় বরাদ্দপ্রাপ্তদের মাঝে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্র জানায়, গত ২৩ জানুয়ারি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করার পর একযোগে জেলার ১০ উপজেলা পরিষদের হলরুমে সুবিধাভোগী পরিবারগুলোর হাতে ঘর ও জমির দলিল তুলে দেয়া হয়। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৪৩, কেন্দুয়ায় ৫০, দুর্গাপুরে ৩৫, পূর্বধলায় ৫৩, কলমাকান্দায় ১০১, মোহনগঞ্জে ৩৬, আটপাড়ায় ৯৮, মদনে ১২৬, বারহাট্টায় ৪৫ ও খালিয়াজুরী উপজেলায় ৪৪৩ পরিবার রয়েছে।
পূর্বধলা উপজেলায় ৫৩ ঘর নির্মাণের জন্য প্রতিটি ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা করে মোট ৯০ লাখ ৬৩ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ওই প্রকল্পের গৃহ নির্মাণ বাস্তবায়নে সভাপতি হিসেবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উম্মে কুলসুম ও কাজের তদারকির জন্য উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম দায়িত্ব পালন করেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, উপজেলার বিশকাকুনি ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ধলা এলাকায় ১২টি ঘর নির্মাণ করা হয়।
আরও পড়ুন: এটাই সবচেয়ে বড় উৎসব, গৃহহীনদের ঘর দেয়া নিয়ে বললেন শেখ হাসিনা
স্থানীয়রা জানান, উদ্বোধনের পর আটটি ঘরের মেঝ ও দেয়ালসহ বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দেয়। বিষয়টি এলাকায় আলোচনায় উঠে আসে এবং ফেসবুকেও সমালোচনা শুরু হয়।
রাজমিস্ত্রি জামাল মিয়া জানান, প্রায় ২০ জনের মতো শ্রমিক মিলে গত দেড় মাসে ঘরগুলো নির্মাণ করেছেন। সময় কম পাওয়ায় দ্রুততার সাথে কাজ করতে হয়েছে। ভিটের মাটি নরম থাকায় ঘরগুলোতে ফাটল ও মেঝে দেবে গেছে। দিন দিন আরও ফাটল বাড়তে পারে বলে তিনি আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।
ধলা গ্রামের রবিকুল ইসলাম ও স্ত্রী বিউটি আক্তারকে বরাদ্দ দেয়া ৭ নম্বর ঘরের দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে।
আরও পড়ুন: গৃহহীন ৬৬ হাজার পরিবারকে ঘর দিলেন প্রধানমন্ত্রী
বিউটি বলেন, ‘আমরার নামে পাওয়া এই ঘরডায় একটু ভেতরে আইয়া দেহুন, সব ফাইটা গেছে। অহনও ঘরে পারও হই নাই, ভয় করতাছে যদি ভাইঙ্গা মাথার ওপরে পড়ে। তিনডা ছুডু ছুডু আবুদুব লইয়া থাহন লাগবো।’
১১ নম্বর ঘরের বরাদ্দপ্রাপ্ত দুদু মিয়া, ৯ নম্বর ঘরের মরিয়ম আক্তার, ১ নম্বর ঘরের সুমন মিয়ার বাবা আলা উদ্দিন ও ৮ নম্বর ঘরের সাবজান বেগম জানান, তারা এখনো ঘরে বসবাস শুরু করেননি। তাদের ঘরগুলোতে বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আবু বক্কর, ওয়ালী উল্লাহসহ বেশ কয়েকজনের অভিযোগ, গৃহ নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার ও সিমেন্ট কম দিয়ে মিস্ত্রিরা কোনোরকমে ঘর তৈরি করে দিচ্ছেন। এ জন্যই দেয়াল, মেঝেতে ফাটল দেখা দিয়েছে। বর্ষা শুরু হলে বেশির ভাগ ঘরই টিকবে না, ভেঙে পড়ে যাবে। তারা সরকারের কাছে টেকসই মজবুত ঘর নির্মাণের জন্য দাবি জানান।
আরও পড়ুন: ‘সারাদিন কষ্টের পরে একটু শান্তিতে পাকা ঘরে ঘুমাতে পারবো’
আশি বছরের বিধবা সাবজান বেগম বলেন, ‘এই কুলে আমার দুই ছেরার মধ্যে একজন প্রতিবন্ধী, আরেকজন মাইনসের বাড়িত কাম করে। আমি ভিক্ষা করে চলি। প্রধানমন্ত্রী আমারে একটা ঘর উপহার দিয়েছেন। এই ঘরের ওয়ালডা ফাইট্টা গেছে। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) তো ঠিকই দিছেন, মেস্তরিরা কাম ভালা করছে না। এই ঘর যদি ভাইঙ্গা আমার শইলের ওপরে পড়ে, ঘরের মধ্যে যদি আমার জীবন শেষ হয়, তাইলে এই ঘরের আমার কোনো দরকার নাই।’
স্থানীয় বিশকাকুনি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য খলিলুর রহমান দাবি করেন, ঘরগুলো ঠিকভাবেই বানানো হয়েছিল। কিন্তু সময় কম থাকায় ও আশপাশে ইরি খেতে পানি দেয়ায় ঘরে ফাটল ও দেবে গেছে। কিছু দিন পরে ঠিক হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন: ‘স্বপ্নেও কল্পনা করিনি ইটের একখানা নতুন ঘর পাবো’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উম্মে কুলসুম বলেন, ‘১২টি ঘরের মধ্যে বেশির ভাগ ঘরের দেয়াল ফেটে যাওয়ার সংবাদ পেয়ে আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। আমাদের তদারকি বা আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতি ছিল না। প্রতিটি ঘরই ভালো ইট, সিমেন্ট, বালু, কাঠ, টিন দিয়ে যত্নসহকারে নির্মাণ করা হয়েছে। এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু ভিটের মাটি এটেল হওয়ায় চারপাশের বোরো জমিতে পানি দেয়ার ফলে ঘরগুলোর এই দশা হয়েছে। এগুলো আমাদের তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছে।’
জেলা প্রশাসক (ডিসি) কাজী মো. আব্দুর রহমান বলেন, ‘সোমবার ধলা গ্রামের ঘরগুলো পরিদর্শন করেছি। ঘরগুলো প্রয়োজনীয় মেরামতের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করতে উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছি। সঠিকভাবে সব কাজ শেষ হওয়ার পর সুবিধাভোগীদের মধ্যে ঘরগুলো হস্তান্তর করা হবে। আমি সর্বোচ্চভাবে নজরে রাখছি। আশা করি কোনো অসুবিধা হবে না।’
আরও পড়ুন: একটি ঘরের অপেক্ষায় গৌরদাস
তিনি বলেন, ‘ঘটনাস্থলে মাটির সমস্যা নজরে পড়েছে। সেখানে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না, সঠিক কী কারণে এমন হয়েছে তা বের করতে অতিরিক্ত জেলা হাকিমকে (এডিএম) প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’