পেশাগত জীবনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে ব্যক্তিজীবনে সাংবাদিকেরা ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে পারেন না। ফলে নারীদের ক্ষেত্রে পরিবার ও কর্মস্থলের অসহযোগিতার জন্যে সন্তান ধারণের পর সাংবাদিকতা ছেড়ে দেবার নজিরও আছে অনেক।
কিন্তু আবার অনেক নারীও রয়েছেন যারা কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সাংবাদিকতা ও মাতৃত্বের মধ্যে ভারসাম্য রেখে চলেছেন।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে কেন্দ্র করে আমরা কথা বলেছি প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার এমনই তিন নারী সাংবাদিকের সাথে।
ফালগুনী রশীদ (স্টাফ রিপোর্টার, একাত্তর টেলিভিশন)
প্রায় এক দশক ধরে সাংবাদিকতায় রয়েছেন ফালগুনী রশীদ। পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। সাংবাদিকতা শুরুর দিনগুলোতে প্রেসক্লাবে হওয়া বিভিন্ন ইভেন্টের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখতেন তিনি একাই মেয়ে এসেছেন!
স্নাতক শেষ বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা চলাকালীন নিজের ভেতরে ছোট্ট প্রাণের অস্তিত্ব টের পান তিনি। গর্ভধারণ, শেষ বর্ষের পরীক্ষা, সাংবাদিকতা সবকিছু মিলে এক রকম বিষণ্ণতা পেয়ে বসে তাকে। তবে সৌভাগ্যক্রমে প্রথম থেকে পরিবারের সদস্য ও কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সহায়তায় সামনের দিকে এগিয়ে গেলেও তা মসৃণ ছিল না।
মাত্র চার মাসের শিশু সন্তান ঐশিককে বাসায় রেখে কাজে ফেরেন ফালগুনী। সারাদিনের কর্মব্যস্ত জীবনে সন্তানের মুখ বার বার ভেসে উঠলেও কিছু করার ছিল না তার। তবে সবচেয়ে বেশি কঠিন সময় ছিল, সন্তানের অসুস্থ থাকার দিনগুলোতে।
এমনিতে নানুর সাথে লক্ষী বাচ্চাটি হয়ে থাকলেও অসুস্থতার সময় ঐশিক শুধুই মায়ের সান্নিধ্য চাইতো। অন্য পেশায় হয়তো আগে থেকে নির্ধারিত কোন অনুষ্ঠান, মিটিং পিছিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু সাংবাদিকতায় সে সুযোগ কোথায়! দিনে কিংবা রাতে যখন প্রয়োজন হয়, অসুস্থ সন্তানকে রেখেই নেমে পড়তে হয় সংবাদের পেছনে। আর নিজের পেশাদারিত্বের মধ্যে কর্মজীবী মায়েদের সন্তানদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন তিনি।
সপ্তাহখানেক আগে ঐশিক ভুগেছে টাইফয়েড জ্বরে। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় থাকা ছেলের পাশে থেকে তার মনে হয়েছে, ‘আমি যদি সার্বক্ষণিক শুধু মা হয়েই থাকতে পারতাম, সারাক্ষণ ওকে চোখে চোখে রাখতে পারতাম, তাহলে হয়তো ছেলেটাকে এত কষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে হতো না।’
এসব কথা বলতে বলতেই সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে থাকেন ফালগুনী। কয়েক বছর পর যখন ঐশিকের স্কুলে পড়াশোনার প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে, মায়ের পর্যাপ্ত সময়ের অভাবে সে অন্য বাচ্চাদের চাইতে পিছিয়ে পড়ে কিনা শঙ্কা জাগে মনে।
ঐশিকের দু’বছর বয়সের সময় আলোচিত ইস্যু রোহিঙ্গা সম্পর্কিত খবর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে প্রথমবারের মতো কক্সবাজারে যান ফালগুনী। শিশু সন্তানকে ছাড়া প্রায় দুই সপ্তাহ সেখানে থাকতে হয় তাকে। পরবর্তীতে নেপালের ত্রিভুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস বাংলার একটি বিমান বিধস্তের পর মর্মান্তিক ঘটনার সংবাদ সংগ্রহে পাড়ি জমান হিমালয়ের দেশে। ভিনদেশে এ দূরত্বের সময়টা খুব কষ্টে কেটেছে তার।
ছেলে ঐশিকের সাথে ফাল্গুনী রশিদ
পরবর্তীতে তিন বছর চেষ্টা করেছেন যেন ঢাকার বাইরের ইভেন্টগুলোতে যেতে না হয়। আবার এটিও অকপটে স্বীকার করে নিলেন, যখন ভীষণভাবে কাজে ডুবে থাকেন তখন ছেলের খবর নিতেও ভুলে যান তিনি! তখন নাকি নিজের কাছেই নিজেকে স্বার্থপর মনে হয় ফালগুনী।
ঐশিকের বয়স এখন প্রায় সাড়ে চার বছর। চার মাস বয়স থেকে মায়ের ছুটে চলা দেখে আসার ঐশিক এখন অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মায়ের দৈনন্দিন রুটিনের সাথেই মানিয়ে নিয়েছে নিজেকে। মায়ের অফিস যাবার সময় হলেই হাসিমুখে মাকে এগিয়ে দিতে আসে সে। সাংবাদিক মায়ের সন্তানের এই অভ্যস্ততা তো সহজাতই!
মাকসুদা আজীজ (মোবাইল জার্নালিজম স্পেশালিস্ট, প্রথম আলো)
মাকসুদা যখন মা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তখন চাকরিতে তার শিক্ষানবিশ কাল চলছে। শুরু থেকেই মাতৃত্বজনিত জটিলতায় থাকা মাকসুদাকে তাই বাইরের কোনো ইভেন্ট নয়, ডেস্কের কাজ সামলানোর অনুমতি দেয়া হয়।
প্রচলন রয়েছে যে, কাজের ক্ষেত্রে যথাযথ সময় না দেয়া এবং সম্পর্ক রক্ষা না করা সংবাদকর্মীদের দক্ষতা কমিয়ে দেয়। কর্তৃপক্ষের কর্মীর উপর অনাস্থাও তৈরি হয়, এমন অনুধাবন থেকেই আস্তে আস্তে কাজে সময় বাড়ানো শুরু করলেন মাকসুদা।
‘প্রথম প্রথম এভাবে কাজ করতে সমস্যা হতো, কিন্তু আমার সঙ্গী আস্তে আস্তে ঘরের এবং বাচ্চার কাজে দক্ষ হয়ে উঠেন। এতে কাজ অনেক সহজ হয়,’ বলছিলেন মাকসুদা।
মাকসুদা শুরু থেকে সন্তানকে নিজের কাজ নিজে করার শিক্ষা দিয়েছেন। তার পাঁচ বছরের কন্যা অপরাজিতা মায়ের সঙ্গে মাঝে মধ্যে অফিসে এবং অ্যাসাইনমেন্টেও যায়। অফিস তার কাছে পরিবারের মতো।
মেয়ে অপরাজিতার সাথে মাকসুদা আজীজ
ব্যক্তিজীবন ও সাংবাদিকতার ভারসাম্য রক্ষা করার বিষয়ে মাকসুদা মনে করেন, কাজ ও বাসা দু’টি আলাদা জায়গা। দুটোকে আলাদা গুরুত্ব দিতে হবে। বাসাকে অফিসে এবং অফিসকে বাসায় না আনলেই সমস্যা অনেকটা কমে যায়। এক্ষেত্রে বাড়ি এবং অফিস দুই পক্ষের সহযোগিতায় সাংবাদিকতা এবং মাতৃত্বে ভারসাম্য রাখতে সহায়তা করে।
বাড়ি ফিরতে রাত হওয়া বা কাজের জন্য বাড়ি থেকে দূরে থাকাকে মাকসুদা সাংবাদিকতার সমস্যা মনে করেন না। তাঁর মতে, “এটা সামাজিকতার সমস্যা। কাজের জায়গায় নারী পুরুষ সমানে সমান এগোতে হলে সমান কাজ করতে হবে”।
মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক মাকসুদা আজিজের মতে, ‘পুরুষের কাজটাও যেমন কাজ, নারীর কাজটাও তেমন, এটা পরিবারকে জানতে হবে। নারীর অগ্রগতিতে শুধু প্রতিষ্ঠান নয়, পরিবারকেও সমান ভূমিকা রাখতে হবে।’
প্রথম আলোসহ মাকসুদা এখন পর্যন্ত তিনটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন এবং প্রতিটি কর্মস্থল থেকেই সহযোগিতা পেয়েছেন তিনি। তবে তারপরেও প্রতিটি কর্মক্ষেত্রেই ডে-কেয়ার সেন্টারের অভাব বোধ করেছেন এ নারী সাংবাদিক।
কাজী নাফিয়া রহমান (রিপোর্টার, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)
নাফিয়া রহমানের সাথে যখন কথা হলো, তখন ঘড়ির কাঁটা রাত ১২টা ছুঁয়ে গেছে। বাচ্চাকে ঘুম পাড়াতে প্রায় সময়ই মধ্যরাত পেরিয়ে যায়, এরপর সকাল হতেই আবার অফিসের তাড়া।
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহ নিয়ে নাফিয়ার তখন দারুণ ব্যস্ততা। অফিসকে বুঝতেই দেননি যে, তিনি অন্তঃসত্ত্বা। সব ঝুঁকি মাথায় নিয়েই নির্বাচনের সময়টায় নিজের দায়িত্ব পালন করে গেছেন তিনি।
মা হতে চলেছেন বলে বাড়তি সুবিধা নেয়ার বিরোধী ছিলেন প্রথম থেকেই। তবে তার অফিস বিষয়টি জানার পর থেকেই সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করেছে বলে জানান তিনি। তবে মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষ হয়ে যাওয়ার পরের সময়টা যে গর্ভকালীন সময়ের চাইতেও দ্বিগুণ চ্যালেঞ্জের ছিল, তা জানালেন তিনি। ডে-কেয়ার সেন্টারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে চলেছেন এখনো।
মেয়ে সোহার সাথে কাজী নাফিয়া রহমান
একদিনের ঘটনা আলাদা করে বললেন নাফিয়া। নানীর কাছে সবসময় থাকলেও মাকে কাছে না পেয়ে ছোট্ট সন্তান সোহা সেদিন টানা দু’ঘন্টা কেঁদেছে। বাবা, দাদী, ফুফু কেউ কোনভাবেই সোহার কান্না থামাতে পারছিল না। নাফিয়া রহমানের ওপর তখন নির্বাচন নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন তৈরির দায়িত্ব। তিনি অফিসকে বললে হয়তো ছুটি পেতে পারতেন, কিন্তু সাংবাদিক মায়েরা জানেন কীভাবে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। নাফিয়াও চাননি তার দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যাক। তাই তিনি ঠিকই নিজের কাজে অটল থেকেছেন।
সদ্য শেষ হওয়া ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের সময়ও সাত মাসের সোহা মায়ের থেকে দূরে ছিল বহুক্ষণ। শুধু মাতৃদুগ্ধের ওপর একটি শিশু এতো লম্বা সময় বাড়িতে কী খাচ্ছে, কী করছে- সে চিন্তা নাফিয়াকে সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। সাংবাদিকতার কঠিন দায়িত্ব পালনের সময় নানা পরিস্থিতিতে তার মনে হয়েছে, চাকরি ছেড়ে পুরোটা সময় সন্তানের পাশে থাকবেন। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলেও নিয়েছেন, ‘আমরাই তো নারী উন্নয়ন নিয়ে লিখি। আমরা সাংবাদিকেরা মা হবার পরে চাকরি ছেড়ে দিলে, লড়াই চালাতে না পারলে, চ্যালেঞ্জটা ধরে রাখতে না পারলে অন্যদের কীভাবে উদ্বুদ্ধ করব?’
নাফিয়া বিশ্বাস করেন, ‘মা হওয়াটা নারীদের দুর্বলতা নয়, বরং শক্তির জায়গা। পেশাদারিত্বের জন্য হয়তো কর্মজীবী মায়েরা সন্তানকে সবটুকু সময় দিতে পারেন না, তবে কেউ যদি বাচ্চাকে দেখাশোনার জন্যে কাজ বন্ধ করে দেয়, তাহলে তার সন্তান যখন বড় হয়ে এ কথা জানবে তখন উল্টো অনেক বেশি অনুতপ্ত হবে।’
নাফিয়া বলেন, ‘আমি পেশাজীবন ও ব্যক্তিজীবনকে সবসময়ই আলাদা রাখতে চাই। অফিসে বললে হয়তো বিভিন্ন সময় ফেভার পাওয়া যেত। কিন্তু আমি কাজকে কাজের মতই দেখতে চাই। মাতৃত্ব যেন আমার কাজে ছায়া না ফেলে, সে চ্যালেঞ্জটা মোকাবেলা করেই এগুতে চাই।’
নারী সাংবাদিকেরা মনে করেন, প্রতিটি গণমাধ্যমেরই উচিত নতুন মায়েদের প্রতি সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করা, তবে ঠিক ছাড় দেয়া নয়। শুধু মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটিয়ে আসার পরের কয়েকটা মাস অফিসগুলো যদি কিছুটা ‘সহনীয়’ হয়, তাহলে মায়েদের জন্য সবকিছুই অনেক সহজ হয়ে যায়।
সত্যিটা হলো, মা হবার পর একজন নারীর কর্মদক্ষতা কমে না বরং তিনি আগের চাইতেও মেধায়-মননে, দায়িত্বজ্ঞানে অনেক বেশি পরিপক্কতা অর্জন করেন বলে মনে করেন তারা।