চ্যাম্পিয়ন্স লিগে হতাশাজনক পারফরম্যান্সের পর লিগ ম্যাচে ফের জ্বলে উঠল বার্সেলোনা। হারের হতাশা ভুলে ভিয়ারিয়ালের মাঠ থেকে বড় জয় নিয়ে ফিরল হান্সি ফ্লিকের দল।

এস্তাদিও দে লা সিরামিকায় স্থানীয় সময় রবিবার রাতে ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে ৫-১ ব্যবধানে জিতেছে বার্সেলোনা।

প্রথমার্ধে রবের্ট লেভানডোভস্কি জোড়া গোল করে দলকে এগিয়ে নিলে বিরতির পরই ব্যবধান বাড়ান চলতি মৌসুমে প্রথমবার শুরুর একাদশে জায়গা পাওয়া বার্সেলোনা মিডফিল্ডার পাবলো তোরে। এরপর আরও দুই গোল করে দলের জয় নিশ্চিত করেন পুরো ম্যাচজুড়ে আলো ছড়ানো রাফিনিয়া। অন্যদিকে, প্রথমার্থে ভিয়ারিয়ালের একমাত্র গোলটি করেন আয়োসে পেরেস।

অবশ্য হ্যাটট্রিক করতে পারতেন লেভানডোভস্কি, তবে পেনাল্টি মিস করায় সে গৌরব থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এই পোলিশ তারকা। দুই গোলে লা লিগায় ৬ ম্যাচে ৬ গোল ও দুটি অ্যাসিস্ট হলো তার। এছাড়া পাঁচ গোল করে লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠেছেন রাফিনিয়া।

আরও পড়ুন: শুরুতেই লাল কার্ড, হেরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শুরু বার্সেলোনার

এই ‍দুজনের পাশাপাশি লামিন ইয়ামালের কথা উল্লেখ না করলেই নয়; চলতি মৌসুমে সব মিলিয়ে ৭ ম্যাচ খেলে প্রতি ম্যাচে অন্তত একটি গোলে অবদান রেখেছেন ১৭ বছরে পা দেওয়া এই স্প্যানিশ তরুণ। গোল-অ্যাসিস্ট মিলিয়ে (লেভানডোভস্কির সমান আটটি) সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছেন তিনি। লিগে এখন পর্যন্ত তিন গোলের পাশাপাশি পাঁচটি অ্যাসিস্ট করেছেন তিনি।

স্কোরলাইন দেখে ম্যাচটি একপেশে মনে হলেও পুরো ম্যাচজুড়ে এক মুহূর্তের জন্যেও বার্সেলোনাকে ছেড়ে কথা বলেনি ভিয়ারিয়াল। বার্সা একবার আক্রমণে উঠলে পরমুহূর্তে আক্রমণে উঠেছে মার্সেলিনোর শিষ্যরা। তবে অফসাইড আর ভাগ্যের ফেরে বল পোস্টে লাগায় বেশ কয়েকটি গোলবঞ্চিত হয়েছে তারা।

ম্যাচজুড়ে বার্সেলোনার ১৬টি শটের বিপরীতে ১৪টি শট নেয় ভিয়ারিয়াল। তবে শট লক্ষ্যে রাখার ক্ষেত্রে ভিয়ারিয়ালকে পেছনে ফেলেছে বার্সেলোনা; তাদের ১০ শট লক্ষ্যে থাকলেও মাত্র চারটি শট গোলমুখে রাখতে পারে ভিয়ারিয়াল।

শুক্রবার রাতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচে বড় ভুলের পর ম্যাচ হারায় টের স্টেগেনকে অনেকে কাঠগড়ায় তুললেও এ ম্যাচের শুরু থেকেই চমক দেখাতে থাকেন এই গোলরক্ষক। তবে প্রথমার্ধের খেলা শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে দলকে নিশ্চিত গোল খাওয়া থেকে বাঁচাতে গিয়ে চোট পান তিনি। মাঠে প্রাথমিক চিকিৎসা দিলে সুস্থ না হওয়ায় পরে স্ট্রেচারে শুয়ে তাকে মাঠ ছাড়তে হয়।

ম্যাচের দ্বিতীয় মিনিটে ভিয়ারিয়ালের বক্সের বাইরে পাওয়া ফাউলের কারণে ফ্রিক কিক থেকে প্রথম শট নেয় বার্সেলোনা। তবে শটটি লক্ষ্যে রাখতে ব্যর্থ হয় তারা।

পঞ্চম মিনিটে সতীর্থের উড়ন্ত পাস দুরুহ হেডারে জালে জড়ানোর চেষ্টা করেন বার্সেলোনা উইঙ্গার রাফিনিয়া। তবে উল্টো হয়ে বলে মাথা ছোঁয়ানোর পর সহজেই তা লুফে নেন ভিয়ারিয়াল গোলরক্ষক দিয়েগো কন্দে।

এরপর অষ্টম মিনিটেই এগিয়ে যেতে পারত ভিয়ারিয়াল। বার্সেলোনার হাইলাইন ডিফেন্স ভেঙে ডান পাশে থাকা ফরোয়ার্ড ইয়েরেমি পিনোকে উড়ন্ত পাস দেন এক সতীর্থ। তা ধরে বক্সে ঢুকে এগিয়ে আসা মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগেনের মাথার ওপর দিয়ে ঠিকানা খুঁজে নেন ২১ বছর বয়সী এই স্প্যানিশ স্ট্রাইকার, কিন্তু অফসাইডের কল্যাণে যে যাত্রায় বেঁচে যায় বার্সেলোনা।

আরও পড়ুন: জিরোনায় বড় জয়ে মধুর প্রতিশোধ বার্সেলোনার

ম্যাচের ত্রয়োদশ মিনিটে ক্ষিপ্র গতিতে আক্রমণে ওঠেন ভিয়ারিয়ালের আইভোরি কোস্ট মিডফিল্ডার নিকোলাস পেপে, কিন্তু বক্সে ঢুকে তিনি কোনাকুনি শট নিলে তা প্রতিহত করে বার্সাকে বিপদমুক্ত করেন টের স্টেগেন।

সপ্তদশ মিনিটে নিশ্চিত গোল থেকে বঞ্চিত হয় বার্সেলোনা। বল নিয়ে বক্সের সামনে এগিয়ে গিয়ে ডান পাশে থাকা লামিন ইয়ামালকে পাস বাড়ান পেদ্রি। সেখান থেকে সামান্য উপর উঠে প্রতিপক্ষের দুই ডিফেন্ডারকে পরাস্ত করে বক্সের ভেতরে ঢুকেই দূরের পোস্ট দিয়ে বাঁকানো শট নেন লামিন, কিন্তু তার শটটি পোস্টে লিগে ফিরে আসে। এরপর রাফিনিয়া বল ধরে গোলে শট নিলেও ভিয়ারিয়ালের রক্ষণে তা প্রতিহত হয়।

পরের মিনিটে দারুণ একটি আক্রমণে ওঠে ভিয়ারিয়ালও, কিন্তু টের স্টেগেনর নৈপুণ্যে গোল করার সুযোগ হারায় তারা।

তবে ২০তম মিনিটে রবের্ট লেভানডোভস্কির একক নৈপুণ্যে ম্যাচে এগিয়ে যায় বার্সেলোনা। প্রথমবার শুরুর একাদশে খেলার সুযোগ পাওয়া পাবলো তোরের থ্রু পাস ধরে বক্সে ঢুকে একের পর এক প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের পরাস্ত করে বল জালে জড়িয়ে দেন ৩৬ বছর বয়সী পোলিশ স্ট্রাইকার।

২৯তম মিনিটে দুই পাশে দুটি দারুণ গোলের সম্ভাবনা বিফলে যেতে দেখে দর্শক।

জুল কুন্দের গোলমুখে বাড়ানো নিচু ক্রস ধরেও তা জালে জড়াতে ব্যর্থ হন লেভানডোভস্কি, অন্যদিকে পিনোর শট টের স্টেগেন ফিরিয়ে দেওয়ার পর রেফারি অফসাইডের বাঁশি বাজান।

৩৩তম মিনিটে বার্সেলোনার আরও একটি আক্রমণ কোনোমতে ফিরিয়ে দিয়ে দলকে বিপদমুক্ত করেন কন্দে। পরের মিনিটে বার্সেলোনার দুর্দান্ত একটি পাল্টা আক্রমণ নিষ্ক্রিয় করে দেন পেপে।

তবে ওই আক্রমণ থেকে পাওয়া কর্নার থেকেই আক্রমণ সাজিয়ে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন লেভনডোভস্কি।

কর্নার থেকে দূরের পোস্টে ক্রস দিলে তা আরও দূরে চলে যায়। সেখান থেকে ফাঁকায় থাকা লামিন বল ধরে বিপরীত পাশের গোল পোস্টের কাছাকাছি ক্রস বাড়ান। ক্রসটি গোলমুখে থাকা লেভানডোভস্কি ধরতে ব্যর্থ হলেও তার পেছনে থাকা এরিক গার্সিয়া হেডারে লেভানডোভস্কির কাছে বাড়ালে বাইসাইকেল কিকে ঠিকানা খুঁজে নেন এই স্ট্রাইকার।

আরও পড়ুন: রাফিনিয়ার হ্যাটট্রিক, ৭-০ ব্যবধানে জিতল বার্সেলোনা

এর ফলে চলতি মৌসুমে ৬ ম্যাচে লেভানডোভস্কির গোলসংখ্যা হলো ছয়টি। পাশাপাশি দুটি অ্যাসিস্ট থাকায় লিগে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ গোলদাতার পাশাপাশি সর্বোচ্চ গোলে অবদান রাখা খেলোয়াড়ও হয়ে গেলেন তিনি।

এর তিন মিনিট পরই বার্সেলোনার দুর্বল রক্ষণ ভেঙে এগিয়ে গিয়ে আয়োসে পেরেসকে দিয়ে গোল করার নিকোলাস পেপে।

৪৩তম মিনিটে মোনাকো ম্যাচের খলনায়ক টের স্টেগেনের নৈপুণ্যে দ্বিতীয় গোল খাওয়া থেকে বেঁচে যায় বার্সেলোনা।

এ সময় বার্সেলোনার নড়বড়ে হাই লাইন রক্ষণ ভেঙে আবারও এগিয়ে যান পেপে। এরপর তার সামনে শুধুই টের স্টেগেন, কিন্তু সঠিক সময়ে এগিয়ে এসে পেপের শট নেওয়ার জায়গা কমিয়ে দেন এই গোলরক্ষক। শেষ পর্যন্ত পোস্টের বাইরে দিয়ে বল মারেন এই আইভোরিয়ান মিডফিল্ডার।

ওই আক্রমণ মোকাবিলা করতে গিয়ে চোট পেয়ে মাঠ ছাড়তে হয় টের স্টেগেনকে। ফলে প্রথমার্ধের খেলা শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট আগে থেকে ম্যাচের বাকি অংশটুকু বার্সার গোলপোস্ট সামলান ইনিয়াকি পেনিয়া।

এরপর যোগ করা সময়ের একেবারে শেষ মুহূর্তে সমতায় ফেরার আরও একটি চমৎকার সুযোগ তৈরি করে ভিয়ারিয়াল, কিন্তু দূরের পোস্ট বরাবর বাড়ানো সতীর্থের পাসে পা ছোঁয়াতে ব্যর্থ হন আয়োসে পেরেস। ফলে পিছিয়ে থেকেই বিরতিতে যায় স্বাগতিকরা।

আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে প্রথমার্ধের মতো দ্বিতীয়ার্ধেও জমে ওঠে ম্যাচ। এর মধ্যে পরপর দুটি সুযোগ পায় ভিয়ারিয়াল। ৫২তম মিনিটে পেপের শট ঠেকিয়ে দেন পেনিয়া, পরমুহূর্তেই পিনোর শট ক্রসবারে লাগে।

তবে ৫৮তম মিনিটে তৃতীয় গোলটি পেয়ে যায় বার্সেলোনা। পেদ্রির পাস ধরে বক্সের বাইরে থেকে বাঁ পায়ের বুলেট শটে লক্ষ্যভেদ করেন পাবলো তোরে। এর ফলে গত মৌসুমে একাদশে জায়গা না পেয়ে জিরোনায় ধারে খেলে এ মৌসুমে প্রথমবার শুরুর একাদশে জায়গা পেয়েই তা কাজে লাগান ২১ বছর বয়সী এই স্প্যানিশ মিডফিল্ডার।

৬৬তম মিনিটে পেনাল্টি আদায় করেন লামিন, কিন্তু স্পট কিক থেকে হ্যাটট্রিক পূরণ করতে ব্যর্থ হন লেভানডোভস্কি। তার নিচু শটটি বাঁ পাশের পোস্টে লেগে ফিরে আসে।

এর দুই মিনিট পর দ্বিতীয় গোলটি পেতে পারত ভিয়ারিয়াল, কিন্তু এবারও গোলটি অফসাইডের কারণে বাতিল করে দেন রেফারি। সতীর্থের ক্রসে বক্সের মধ্যে থেকে হেডারে লক্ষ্যভেদ করেন ম্যাচজুড়ে ভিয়ারিয়ালের হয়ে অসাধারণ পারফর্ম করা পেপে। তবে রিভিউতে দেখা যায়, তার উদ্দেশে যখন বল বাড়ানো হচ্ছে, তখন বেশ খানিকটা অফসাইডে রয়েছেন তিনি। ফলে ব্যবধার আর কমানো হয়ে ওঠেনি স্বাগতিকদের।

৭৩তম মিনিটে রাফিনিয়া-লামিনের একটি পাল্টা আক্রমণ বক্সের মধ্যে নিষ্ক্রিয় করে দেন ভিয়ারিয়ালের খেলোয়াড়রা।

আরও পড়ুন: বিলবাওয়ের বিপক্ষে ঘাম ঝরানো জয় বার্সেলোনার

৭৫তম মিনিটে অবশেষে গোলের দেখা পান পুরোটা সময় মাঠজুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো রাফিনিয়া। ফলে ৪-১ গোলে এগিয়ে যায় বার্সেলোনা।

বক্সের মধ্যে জটলার ভেতর থেকে বল কিছুটা পেছনে চলে এলে ছুটে গিয়ে দারুণ শটে ভিয়ারিয়াল গোলরক্ষককে দর্শক বানান এই ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ড।

ম্যাচের ৮৩তম মিনিটে আরও একবার লামিন-রাফিনিয়ার অসাধারণ যুগলবন্দি দেখে দর্শক। আর তা থেকে নিজের দ্বিতীয় ও দলের পঞ্চেম গোলটি করেন রাফিনিয়া।

ডান পাশ ধরে পাল্টা আক্রমণে উঠে মাঝমাঠের লাইন পার হয়েই বিপরীত পাশ দিয়ে এগোতে থাকা রাফিনিয়াকে পায়ের পাতা দিয়ে উড়ন্ত লং পাস দেন লামিন। তা ধরে বক্সে ঢূকে নিখুঁতভাবে ঠিকানা খুঁজে নেন রাফিনিয়া।

এই গোলে লিগে তার গোলসংখ্যা হলো পাঁচটি, এর ফলে সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় সতীর্থ লেভানডোভস্কির পরই জায়গা করে নিলেন ২৭ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড।

এছাড়া অসাধারণ অ্যাসিস্টের ফলে চলতি মৌসুমে প্রত্যেক ম্যাচে অন্তত একটি গোলে অবদান রাখার কীর্তি গড়লেন লামিন ইয়ামাল।

এরপর দুই দলের কেউই তেমন আক্রমণে না উঠলে বড় জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে ফ্লিকের শিষ্যরা।

এই জয়ে লা লিগায় নিজেদের অপরাজেয় যাত্রা ধরে রাখল বার্সেলোনা। টানা ৬ ম্যাচ জিতে পূর্ণ ১৮ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের শীর্ষে তারা। শুধু তা-ই নয়, লিগে সবশেষ তিন ম্যাচে ১৬টি গোল করেছে ফ্লিকের শিষ্যরা। এসময় গোল হজম করেছে মাত্র দুটি।

আরও পড়ুন: বার্সার দায়িত্ব নিয়ে শিরোপা জিততে বদ্ধপরিকর ফ্লিক

সমানসংখ্যক ম্যাচ খেলে ৪ পয়েন্ট কম নিয়ে পয়েন্ট টেবিলের দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। ৭ ম্যাচ খেলে ১৩ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় স্থানে আথলেতিক বিলবাও। রিয়াল-বার্সার চেয়ে এক ম্যাচ কম খেলে ১১ পয়েন্ট নিয়ে চতুর্থ স্থানে আতলেতিকো মাদ্রিদ।

রায়ো ভায়েকানোর বিপক্ষে আজ রাতে ষষ্ঠ রাউন্ডের ম্যাচটি জিতলে রিয়ালের সমান পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় স্থানে উঠে যাবে দিয়েগো সিমিওনের শিষ্যরা। আর ষষ্ঠ ম্যাচ হেরে ১১ পয়েন্ট নিয়ে পঞ্চম অবস্থানে রইল ভিয়ারিয়াল।

লা লিগায় আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে গেতাফের বিপক্ষে মাঠে নামবে বার্সেলোনা। অন্যদিকে, পরের দিন রাতে এসপানিওলের মাঠে খেলতে যাবে ভিয়ারিয়াল।