বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিনের ছুটি কাটিয়ে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। ভার্চুয়াল থেকে সশরীরে ক্লাসে ফিরেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরের শিক্ষার্থীরা। আর এই ক্লাসে ফেরা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিতে নজরদারীতে এনেছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি)।
শিক্ষার্থীদের জন্য ইতোমধ্যে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক স্বাস্থ্য সেবায় সার্বক্ষণিক কাজ করছে ‘সাস্ট মনের কথা’ ফেসবুক পেইজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ ও নির্দেশনা পরিচালকের অধীনে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সেবাটি পরিচালনা হচ্ছে। এতে কাজ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট ফজিলাতুন্নেছা শাপলা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংযুক্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারী কারও মানসিক সমস্যা দেখা দিলে সরাসরি সম্ভব না হলে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ‘সাস্ট মনের কথা’ ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে যোগাযোগ করে সার্বক্ষণিক মানসিক বিষয়ক স্বাস্থ্য সেবা পাওয়া যাবে। এই মানসিক স্বাস্থ্য সেবায় সর্বদা গোপনীয়তা রক্ষা করে সেবা দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিটি বিভাগে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পুরুষ ও নারী আলাদাভাবে দুইজন করে শিক্ষক ছাত্র উপদেষ্টা বিদ্যমান।
আরও পড়ুন: করোনার দীর্ঘ ছুটিতে নতুন আঙ্গিকে শাবিপ্রবির চিকিৎসা কেন্দ্র
করোনাকালীন প্রথম থেকেই অনলাইন কার্যক্রমে সচল ব্যবস্থাপনা চালু রেখেছিল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। তবে শিক্ষার্থীদের স্বশরীরে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ক্লাসের আক্ষেপটি দেখা যায় শিক্ষার্থীদের মাঝে। এছাড়াও দীর্ঘ এই ছুটিতে বিশ্ববিদ্যালয়টির বাংলা বিভাগের ২০১৮-১৯ বর্ষের শিক্ষার্থী তোরাবি বিনতে হক, একই বিভাগের ২০১৯-২০ বর্ষের আছিয়া আকতার, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ বর্ষের তৌহিদুল আলম প্রত্যয়ের আত্মহত্যা ও রসায়ন বিভাগের ২০১৯-২০ বর্ষের শিক্ষার্থী সাব্বির আহমেদের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু কাঁদিয়েছে শাবিপ্রবিয়ানদের হৃদয়কে। চলতি বছরের ৬ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১২-১৩ বর্ষের রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী আলমগীর কবির ও ১৬ অক্টোবর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান দেশের বাইরে উচ্চ শিক্ষার জন্য পড়াশোনা করতে গিয়ে আত্মহত্যার মতো ঘটনাগুলো শাবিপ্রবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে হৃদয় বিদারক পরিবেশ তৈরি করেছে।
দীর্ঘ ছুটির পর ক্যাম্পাসে ফেরা নিয়ে কথা হয় শিক্ষার্থীদের সাথে। বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী ফারজানা আকতার বলেন, কোভিড-১৯ শুরু হওয়ার পর থেকে গত দেড় বছরে শাবিপ্রবি থেকে অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে কিছু মানুষকে আমরা হারিয়েছি। এর মধ্যে পাঁচজন আত্মহত্যা করেছেন, যাদের মধ্যে একজন শিক্ষকও ছিলেন। একজন মানুষ কতোটা অসহায় হলে আত্মহত্যার মতো কঠিনতম সিদ্ধান্তে চলে যায় তা হয়তো আমরা জানি না। কিন্তু কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে মানসিক ও শারিরীকভাবে সুস্থ্ থাকার জন্য একজন মনোবিজ্ঞানীসহ ছাত্র উপদেষ্টা-ছাত্র কল্যাণ উপদেষ্টা এবং শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মহোদয়গণ অনলাইনে নানা সময়ে বিভিন্ন সেশন, আলোচনা অনুষ্ঠান ইত্যদির আয়োজন করে এসেছেন।
আরও পড়ুন: ক্যান্সারে মারা গেলেন শাবিপ্রবির শিক্ষার্থী
তিনি বলেন, প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী যারা মাত্র দেড় মাস ক্যাম্পাসে কাটানোর পর দীর্ঘ দেড় বছর বাড়িতে কাটিয়ে এখন একজন দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হিসেবে ক্যাম্পাসে ফিরছেন তাদেরসহ সকল শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যায় কিংবা কঠিন কোনো পরিস্থিতিতে তাঁরা পরামর্শ দিয়ে যাবেন এবং শিক্ষার্থীরাও পরিবেশ-পরিস্থিতির এই নানা উত্থান-পতনে হতাশাগ্রস্থ না হয়ে মানসিকভাবে শক্তিশালী থাকার চেষ্টা করবেন বলে আশা রাখছি।
অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষ প্রথম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী প্রবাল বড়ুয়া বলেন, দীর্ঘ দেড় বছর পর আমরা সশরীরে ক্লাসে উপস্থিত হয়েছি। এই মহামারিতে যদি মানসিক অবস্থা চিন্তা করি তাহলে একপ্রকার বলা যায় শোচনীয় অবস্থায় ছিল। অনলাইন ক্লাসে যেহেতু আমাদের পাঠদান সম্পন্ন হচ্ছিল, ডিভাইস সমস্যা, নেটওয়ার্ক সমস্যা, ফ্যামিলির সমস্যা আরও অনেক ধরনের সমস্যার কারণে ক্লাসে ভালোভাবে উপস্থিত হতে পারি নি। যেহেতু ক্লাসগুলো এখন সশরীরে হচ্ছে সেহেতু ক্লাসগুলোতে আমরা নিয়মিত উপস্থিত হতে পারছি এবং আমরা মানসিকভাবে সতেজ থাকতে পারছি।
হলগুলোতে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ মোহাম্মদ সামিউল ইসলাম বলেন, একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিজ বিশেষ করে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। ইনডোর- আউটডোর খেলাধুলা এবং এক্সট্রা কারিকুলার কর্মকান্ড শিক্ষার্থীদের নির্মল মানসিক স্বাস্থ্য গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী হলের প্রাধ্যক্ষ ড. জায়েদা শারমীন বলেন, করোনার মতো মহামারি মোকাবেলার অভিজ্ঞতা আমাদের সকলের জন্যই আসলে বিরাট এক চ্যালেঞ্জ হিসেবেই এসেছে। আর এই চ্যালেঞ্জের বড় একটা বিষয় হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যের সঠিক পরিচর্যা নিশ্চিত করা। শিক্ষার্থীদের জন্য এ বিষয়টি আরও বড় ধরনের গুরুত্ব বহন করে বলে আমি মনে করি।
আরও পড়ুন: ওরা আর কখনো শাবিপ্রবি ক্যাম্পাসে ফিরবে না
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে অনেক দিন বাসায় থাকায় একদিকে যেমন তাদের মধ্যে একঘেয়েমিতা দেখা দিয়েছে তেমনি কিছুটা সেশন জ্যাম তৈরির ফলে চাকরির বাজারে প্রবেশের প্রতিবন্ধকতাও একটি বড় অংশের মধ্যে হতাশার জন্ম দিয়েছে। এ ধরনের মানসিক চাপ মোকাবেলায় আমাদের সকলকে ধৈর্যের সাথে একযোগে কাজ করতে হবে। শিক্ষক –শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা -কর্মচারী সকলের মানসিক বিষয়টি প্রয়োজন অনুযায়ী গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার জন্য কাউন্সেলিং সেলের নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ ও তাতে সকলের অংশগ্রহন নিশ্চিত করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট ফজিলাতুন্নেছা শাপলা বলেন, দীর্ঘ ছুটি কাটিয়ে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফিরেছে। অনেক শিক্ষার্থীর কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশটা আগের মতোন নাও মনে হতে পারে এডজাস্টমেন্টের ক্ষেত্রে। সকল শিক্ষার্থীদের জন্য আমাদের দরজা খোলা। অনলাইন, সশরীরে, মুঠোফোনে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা অব্যাহত আছে। ডিপার্টমেন্ট ও হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবায় কাউন্সেলিং, ফলোআপ, মেডিসিনের বিষয়গুলোতে সেবা থাকছে।
শাবিপ্রবি প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক ড.আলমগীর কবীর বলেন, আমাদের শৃঙ্খলা কমিটি শিক্ষার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তায় বিবেচনায় তৎপর। বর্তমানে করোনার এই দীর্ঘ ছুটি শেষে ক্যাম্পাসে ফেরা অনেক শিক্ষার্থী মানসিক সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে এসেছে। আমরা প্রতিটা ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সমাধানে চেষ্টা করছি। এই বিষয়গুলো আমাদের নজরে রয়েছে।
আরও পড়ুন: ফেসবুকে চাকরির সুযোগ পেলেন শাবিপ্রবির দুই শিক্ষার্থী
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ ও নির্দেশনা পরিচালক অধ্যাপক জহীর উদ্দিন আহমদ জানান, লম্বা একটি ছুটি কাটিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে। দীর্ঘ একটা সময় শিক্ষার্থীরা তাদের ব্যস্ততা ভুলে অন্য একটি পরিবেশে মিশে ছিল। আর এই সময়টিতে হল, মেস, বাসা, বিভাগ যেকোনো পরিস্থিতিতে কোনো মানসিক সমস্যা তৈরি হলে শিক্ষার্থীদের বলবো আমাদের কাছে চলে আসতে । আমরা শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন ও অফলাইন দুই জায়গাতেই এই মানসিক স্বাস্থ্য সেবা চালু রেখেছি। শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যার সংকট নিরসনে আমাদের সাইকোলজিস্টসহ শিক্ষক উপদেষ্টাদের আন্তরিকভাবে স্বাস্থ্য সেবা তাদের মানসিক ভীতি দূর করতে সহায়তা করবে। আমরা চাই প্রতিটা শিক্ষার্থী মানসিক সুস্থতার মাধ্যমে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা জীবন পার করে তাদের ভবিষ্যত জীবনেও সুন্দর দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক।
শাবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, শিক্ষার্থীদের সবধরনের সমস্যা নিরসনে আমাদের শিক্ষকরা কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিটি বিভাগ, হলসহ সকল দপ্তরে শিক্ষার্থীদের প্রতি আন্তরিকতার কমতি নেই। এছাড়াও মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় আমাদের প্রতিটি দপ্তরে নির্দেশনা দেয়া আছে। স্ব স্ব জায়গা থেকে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় সকলে একযোগে কাজ করে যাচ্ছে।