তবে, ২৫ বছর বয়সী কলি এখন গৃহহীন নেই। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার হাটিকুমরুল (তৃতীয় লিঙ্গ) আশ্রয়ণ প্রকল্পে স্থায়ী আবাসন পেয়েছেন তিনি। এখন স্বপ্ন দেখতে পাচ্ছেন মর্যাদাপূর্ণ জীবনের।
এখানের আশ্রয়ণ প্রকল্পের চারটি করে আধাপাকা ঘরের এক ব্যারাকে কলির নিজের ঘরও রয়েছে। হাটিকুমরুল প্রকল্পের আওতায় শূন্য দশমিক ৬৬ একর জমিতে নির্মিত পাঁচ ইউনিটের ব্যারাকে প্রায় ২০ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে।
সরকার মুজিববর্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে সারা দেশের ২১ জেলার ৩৬ উপজেলার ৭৪৩ ব্যারাকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া মোট ৩,৭১৫টি পরিবারকে ঘর করে দিয়েছে।
মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার গৃহহীনদের জন্য ঘর
এছাড়াও, গত জানুয়ারি মাসে সরকার মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ উদ্যোগ হিসেবে সারা দেশের ৬৬ হাজার ১৮৯টি পরিবারকে আধাপাকা ঘর করে দিয়েছে। এসব ঘরের প্রতিটি দুই শতক জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বশেষ ২৩ জানুয়ারি মোট ৬৯ হাজার ৯০৪টি পরিবারের মধ্যে ঘর ও ও ভূমির দলিল বিতরণ উদ্বোধন করেছিলেন।
এ প্রকল্প থেকে শুধু তৃতীয় লিঙ্গের কলিই সুবিধাভোগী নন। হাটিকুমরুল প্রকল্প এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের প্রায় ৫০ জন তাদের বাড়িতে শাকসবজি উৎপাদন করছেন বা গরু-ছাগলের মতো গৃহপালিত পশু লালন-পালন করছেন। এর মধ্যে কয়েকজনের সেলাই মেশিনও আছে।
প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে ঘর পাওয়া ২০ জনের সাথে তাদের পরিচিতজনরা এবং সহযোগীদের কেউ কেউ বেড়াতে এসেছেন বা কেউ কেউ একসাথে থাকছেন।
কলির বয়স যখন দুই কি তিন মাস তখন মাকে হারান। তারপর তার বাবা সিরাজগঞ্জ সদরের বাসিন্দা রতন ইসলাম আবার বিয়ে করেন।
কলি বলেন, ‘আমার বয়স তখন নয় বছর। হঠাৎ একদিন আমার সৎ মা এবং প্রতিবেশী এক নারীর মধ্যে ঝগড়ার সময় জানতে পারি আমি একজন হিজড়া।’
শৈশবের বেদনাদায়ক সে কাহিনি জানাতে গিয়ে কলি বলেন, সমাজ তাকে কলঙ্ক দিয়েছে এবং তার সমবয়সীরা তার সঙ্গ এড়িয়ে যেত। ‘ফলে, সেই সময়ে দিনের বেশির ভাগ সময় আমাকে বাড়িতে থাকতে হত।’
সমাজের চরম এ বাস্তবতা সহ্য করতে না পেরে তৃতীয় লিঙ্গের এ শিশুটি নয় বছর বয়সে পরিবার ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং তার মতো অন্যদের সাথে উল্লাপাড়া উপজেলার ধোপাকান্দি এলাকায় এক ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করে। তারা তিনজন একটি ঘরে থাকতেন এবং এর মাসিক ভাড়া ছিল দেড় হাজার টাকা।
কলি বলেন, ‘এখন আমার একটি স্থায়ী নিবাস আছে এবং আমি একটি ঘর পেয়েছি। আমি আমার বাড়ির চারপাশে খোলা জায়গায় শাকসবজি চাষ এবং মুরগির লালন-পালন করতে পারছি। আমরা এখন ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারছি।’
নেত্রকোনায় আশ্রয়ণের ঘরে ২য় সপ্তাহেই ফাটল, তদন্ত কমিটি গঠন
পরী মনির স্বপ্ন
হাটিকুমরুলের কলির মতো একই সম্প্রদায়ের আরও একজন হলেন ১৮ বছর বয়সী পরী মনি। তৃতীয় লিঙ্গের হওয়ার কারণে তাকেও সমাজে অবহেলিত হতে হয়েছে।
পরী মনির বাবা-মা এবং দুই ভাইকে নিয়ে একটি সুন্দর পরিবার আছে। তবে শুধুমাত্র সামাজিক কুসংস্কারের কারণে পরিবারের সাথে থাকতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘পরিবার চায় আমি তাদের সাথে থাকি, তবে আমার কারণে পরিবারের অন্য সদস্যদের সমাজে সম্মানহানি হোক সেটা আমি চাই না।’
ছোটবেলা থেকেই পরী মনির মধ্যে মেয়েলি স্বভাব দেখা দিয়েছিল। যা তার পরিবারের মেনে নিতে অনেক অসুবিধা হয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘আমার বয়স যখন ১২ বছর, একদিন ছেলেদের মতো পোশাক না পড়ায় আমাকে মারধর করা হয়। পরে আমি বাসা থেকে পালিয়ে আসি। তখন থেকেই আমি হিজড়াদের সাথে থাকতে শুরু করি।’
তবে তিনি এখনও মাঝে মাঝে পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করতে বাড়িতে যান, জানান পরী।
খুলনার আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পেয়ে খুশি গৃহহীন পরিবারগুলো
পরী স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন এবং এখন তিনি মডেল হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। ব্যারাকে তাকে থাকার জন্য সুন্দর ঘর ও জমি দেয়ার জন্য তিনি সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘সরকার বাড়ি দিয়ে আমাদের মর্যাদা দিয়েছে।’
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. মাহবুব হোসেন বলেন, আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় দিনাজপুর সদর উপজেলার বাঙ্গিবেচা ব্রিজ সংলগ্ন হিজড়া পল্লীর ব্যারাকে আরও ১৩৫টি তৃতীয় লিঙ্গের পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আরও একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে।
‘হিজড়াদের মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি সরকার তাদের কর্মসংস্থানের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে,’ বলেন তিনি।
ধাপে ধাপে তৃতীয় লিঙ্গের সম্প্রদায়ের সব মানুষকে পুনর্বাসিত করা হবে। সামাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এ জনগোষ্ঠীকে সাধারণ জীবন ফিরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য সব ব্যবস্থা নেবে সরকার, জানান এ প্রকল্প পরিচালক।
সরকারের হিসাব অনুসারে, সারা দেশে ১১ হাজার তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ রয়েছেন। যদিও মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে এই সংখ্যা পাঁচ লাখেও বেশি হতে পারে।
সরকার ২০১৪ সালে তৃতীয় লিঙ্গ পরিচয় দিয়ে হিজড়া সম্প্রদায়কে স্বীকৃতি দিয়েছে।