কার্যকর ও সময়োপযোগী কর্মসূচিতে না গিয়ে বিগত বছরগুলোর মতোই, দলটি বছরেজুড়ে মূলত আলোচনা সভা, দোয়া মাহফিল এবং সংবাদ সম্মেলনের মতো অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সরকার দুই দফায় এক বছরের জন্য মুক্তি দিয়েছে। সরকারের দেয়া সব শর্ত মেনে তিনিও তার গুলশানের বাসভবনে নিরব ও রাজনীতি থেকে দূরে থেকেছেন।
আরও পড়ুন: বিএনপি ভুলের রাজনীতি করে চলেছে: তোফায়েল
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, নেতৃত্বের সঙ্কট, ভুল নীতিমালা এবং রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার কারণে রাজনৈতিক দল হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।
তারা বলছেন, দলটি যদি যোগ্য নেতৃত্ব ও সুদৃঢ় ও সু-পরিকল্পিত রাজনৈতিক কৌশল এবং জনবান্ধব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে না পারে তবে আগামী বছরগুলোতেও দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের অবস্থান ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
রাজনৈতিক হতাশার শুরু
বিএনপি তার ‘আন্দোলনের’ অংশ হিসেবে বছরের শুরুর দিকে ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে অংশ নেয়। তবে, নির্বাচনে ভোটের দিনে তাদের সমর্থক ও পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্রে আনতে ব্যর্থ হয় দলটি।
নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর, দলটি ভোটের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে ২ ফেব্রুয়ারি হরতালের ঘোষণা দিয়েছিল। তবে, এতে জনসমর্থন পাওয়ার পরিবর্তে কেবল সমালোচনার মূখেই পড়তে হয়েছে তাদের।
ইউএনবির সাথে আলাপকালে, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রহমান বলেন, বিএনপিকে নির্বাচনে জিততে দেয়া হবে এমন ধারণা থেকে সিটি নির্বাচনকে গুরুত্বের সাথে নেয়নি দলটি।
আরও পড়ুন: সরকার উন্নয়ন সম্পর্কে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে: বিএনপি
তিনি বলেন, ‘তাদের (বিএনপি নেতাদের) নির্বাচনী প্রচারের সময় দেখা যায় নির্বাচনে জেতার জন্য যে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে কাজ করা দরকার ছিল তা অনেকটা অনুপস্থিত ছিল।’
এ বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘বিএনপি দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ‘অনিয়ম’ হওয়ার প্রতিবাদে রাজধানীতে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছিল। তবে, দলের নেতারা মানুষের মন বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। জনগণ এখন হরতালকে সমর্থন করে না। আমি মনে করি, মানুষকে বুঝতে না পেরে তাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে হরতাল ঘোষণা করে বিএনপির নেতারা তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার প্রকাশ করেছেন।’
করোনায় বিচ্ছিন নেতৃত্বে
মহামারি করোনাভাইরাস দেশে ছড়িয়ে পড়ার পর, গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় সাত মাস বিএনপি তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ রেখেছিল।
সেপ্টেম্বরের পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলে দলটি মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে। ভোট দিবসের দ্বিতীয় বার্ষিকী উপলক্ষে দলটি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রতিবাদে ৩০ ডিসেম্বর দেশব্যাপী বিক্ষোভ সমাবেশ পালনের মধ্য দিয়ে বছরটি শেষ করেছে।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর থেকে বেশিরভাগ দলীয় নেতা আইসোলেশনে চলে গিয়েছিলেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বেশ কিছু ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। দলটির কয়েকটি কর্মসূচিতে সরাসরিও যোগ দিয়েছিলেন তারা। তবে, অন্য নেতারা আড়ালেই ছিলেন।
আরও পড়ুন: সারা দেশে ৩০ ডিসেম্বর বিএনপির বিক্ষোভ
তবে, দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সক্রিয়ভাবে ত্রাণ বিতরণ করতে দেখা গেছে এবং বেকার ও দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, শাহজাহান সিরাজ, এমএ হাশেম, শফিউল বারী বাবু, আবদুল আউয়াল খান, আহসানউল্লাহ হাসান ও শফিউল আজমসহ দলীয় বেশ কয়েকজন কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
মারাত্মক এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন- দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং ভাইস-চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলুর মতো আরও অনেকেই।
খালেদার মুক্তির সম্ভাবনা নেই
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই, দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে দীর্ঘ ২৫ মাস জেল হাজতে থাকার পর এক নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে গত ২৫ মার্চ খালেদা জিয়ার কারাবাসের সাজা স্থগিত করে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দিয়েছিল সরকার।
তবে কোনা আন্দোলন বা বিএনপির সৃষ্ট কোনো চাপের মুখে নয় বরং মানবিক ও স্বাস্থ্যগত কারণ বিবেচনায় নিয়ে সরকার তাকে এ মুক্তি দিয়েছিল।
গত ২৭ আগস্ট তার মুক্তি মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়িয়েছে সরকার।
তবে, মুক্তির পর থেকে খালেদা জিয়া রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং তার দলের নেতাদের এড়িয়ে গিয়ে নিজ বাড়িতে অবস্থান করায় রাজনৈতিকভাবে কোনো ফায়দা করতে পারেনি বিএনপি। কেবল কয়েকটা অনুষ্ঠানে তার সাথে দলের কয়েকজন নেতা দেখা করতে পেরেছেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তাদের দলীয় প্রধানকে মুক্তি দেয়া হলেও কার্যত তাকে ‘গৃহবন্দী’ রাখা হয়েছে।
আরও পড়ুন: বিএনপির কারণ দর্শানোর নোটিশে অপমানিত হাফিজ উদ্দিন
দলের কয়েকজন নেতা বলেন, স্বাস্থ্যগত জটিলতা ও ক্ষীন রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কারণে বিএনপি প্রধান রাজনীতিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।
নির্বাচনের ধরাশায়ী ফলাফল
গত ৭ সেপ্টেম্বর মির্জা ফখরুল তাদের দল আসন্ন সব নির্বাচন ও উপনির্বাচনে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান।
পরে, বিভিন্ন শূন্য সংসদীয় আসন এবং স্থানীয় সরকারের উপনির্বাচনে অংশ নেয়া, তবে ভালো কোনো ফলাফল দেখাতে পারেনি।
সিটি নির্বাচনের মতোই, দলটি ভোটকেন্দ্রে তাদের এজেন্ট এবং দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়।
মির্জা ফখরুল বলেন, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী ও প্রশাসনের বাধা এবং দমনমূলক আচরণের কারণে তারা নির্বাচনে ভালো কিছু করতে পারেননি।
তবে ড. তারেক শামসুর বলেন, ‘দলটি গুরুত্ব সহকারে নির্বাচনে অংশ নিতে তাদের নেতা-কর্মীদের উত্সাহ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আমি আরও মনে করি যে দলের নেতা-কর্মীরা নির্বাচনের বিষয়ে তাদের শীর্ষ নেতাদের কাছ থেকে সঠিক দিকনির্দেশনাও পাননি।’
এছাড়াও, নির্বাচনের পরে অন্তর্দলীয় কোন্দল আরও বেড়েছে এবং দলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সমর্থকরা বিভিন্ন সময়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন।
নতুন কমিটি ঘোষণার কোনো অগ্রগতি নেই
বিএনপি তার বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন পুনর্গঠন করে জাতীয় কাউন্সিলের কথা বলে আসলেও এ ক্ষেত্রে ভালো কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি।
কয়েকটি জেলা ও উপজেলা শাখায় কয়েকটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা ছাড়া দলটির আর কোনো অগ্রগতি নেই।
দলটি সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী স্থায়ী কমিটির তিনটি খালি পদে এবং কার্যনির্বাহী কমিটির প্রায় ৫০টি শূন্য পদ পূরণেও ব্যর্থ হয়েছে তারা।
বছরের শেষ দিকে হাফিজউদ্দিন আহমেদ ও শওকত মাহমুদসহ কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে দলীয় শৃঙ্খলা লঙ্ঘনের দায়ে কারণ দর্শানের নোটিশ প্রদানসহ দলটি গুরুতর আন্তঃদলীয় দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হয়েছে।
এছাড়াও, দলবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অপরাধে বেশ কিছু তৃণমূল নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
দলটির নেতারা বলেছেন, দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে বাধাগ্রস্থ হওয়ায় এ বছর দল পূণর্গঠনের কাজ শুরু করতে পারবেন না।
নতুন নেতৃত্ব দরকার বিএনপির
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, রাজনীতিতে ফিরে আসতে চাইলে কাউন্সিলের মাধ্যমে বিএনপিকে অবশ্যই নতুন নেতৃত্ব নিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে আনতে দলের নেতা-কর্মীদের আন্দোলনকে আরও জোরদার করা উচিত। দলের শীর্ষ নেতাদের অবশ্যই তৃণমূলকে নেতৃত্ব দিতে হবে। নেতাদের মধ্যে থাকা ভুল বোঝাবুঝি দূর করে ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার। বিএনপিকে ইতিবাচক রাঝনীতি করতে হবে।’
ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, নেতৃত্বের সঙ্কটের কারণে বিএনপি একটি বড় দল হিসেবে দাঁড়াতে পারছে না।
তিনি বলেন, বিএনপি নেতারা সবসময় লন্ডন থেকে মেসেজের জন্য অপেক্ষা করেন এবং বক্তব্যের ফুলঝুড়ি দিয়ে যাচ্ছেন। তারা তৃণমূলকে পুনরুজ্জীবিত করতে ও দলকে শক্তিশালী করে তাদের সংগঠনকে শক্তিশালী বা কোনো কৌশল বাস্তবায়ন করতে পারছে না।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সদ্য সমাপ্ত বছর কেবল বিএনপি জন্য নয়, বরং সারা বিশ্বের জন্য অত্যন্ত কঠিন ছিল। মহামারিটি সবকিছুকে উল্টা-পাল্টা করে ফেলেছে। রাজনীতিতেও এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
আরও পড়ুন: নাটোরে বিএনপির গণতন্ত্র হত্যা ও আ’লীগের গণতন্ত্রের বিজয় মিছিল
তিনি বলেন, করোনাভাইরাস বিস্তারের কারণে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি বজায় রেখে এ বছর সীমিত আকারে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন তারা।
ফখরুল আশা করেন, সরকারে পরিবর্তন আনতে এবং গণতন্ত্র ‘পুনরুদ্ধারে’ ২০২১ সালে জনগণকে সাথে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে সাফল্য নিয়ে আসবে।
‘আগামী বছরে ঐক্যের জন্য সবারই একই সংকল্প করা উচিত,’ বলেন তিনি।