বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, মূলত ভ্যাকসিন তৈরির গবেষণা চলছে উন্নত দেশগুলোতে। কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরির পর এই দেশগুলো যে নিজেদের নাগরিকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন সরবরাহ করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এর ফলে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এসব ধনী দেশের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে।
এই সঙ্কট খুলে দিয়েছে ভ্যাকসিন কূটনীতির দুয়ার। কোভিড-১৯'র গবেষণা ও উৎপাদনের সাথে জড়িত কিছু দেশ এই ভ্যাকসিনকে ব্যবহার করছে তাদের প্রভাব বিস্তার ও স্বার্থসিদ্ধির কাজে।
ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত এক নিবন্ধের হিসেব অনুযায়ী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য ১৯৪টি দেশে করোনার দুটি ভ্যাকসিনের জন্য ১ হাজার ৫০০ কোটিরও বেশি ডোজের প্রয়োজন হবে। এই হিসেবটা করা হয়েছে যদি কে আগে কে পরে পাবে সেই বিবেচনা করা না হয়।
নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, করোনার ২৭৩টি ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা চললেও মোট ১২টি কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন গবেষণার তৃতীয় ধাপ পার হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকটি ভ্যাকসিনের ৭০ শতাংশ থেকে ৯৫ শতাংশ কার্যকারিতা লক্ষ্য করা গেছে।
এরই মধ্যে ছয়টি ভ্যাকসিনকে বিভিন্ন দেশের সরকার জনগণের ওপর ব্যবহারের জন্য অনুমতি দিয়েছে।
আরও পড়ুন: করোনার টিকা: ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমতি পেল দেশের গ্লোব বায়োটেক
টিকা সরবরাহ: ঢাকার উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই বলে জানাল দিল্লি
এগুলো হলো- ফাইজার-বায়োএনটেক কোম্পানির তৈরি টোজিনামেরান, মডার্না কোম্পানির এমআরএনএ-১২৭৩, চীনা কোম্পানি সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাকের দুটি ভ্যাকসিন, রুশ কোম্পানি গামালেয়া রিসার্চ ইন্সটিটিউটের তৈরি একটি এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি একটি ভ্যাকসিন।
এসব ভ্যাকসিন হাতে পাওয়ার জন্য ধনী দেশগুলো অনেক আগে থেকেই আগাম বুকিং দিয়ে রেখেছে।
চরম স্বাস্থ্য সঙ্কটের মুখে দরিদ্র দেশগুলোও চেষ্টা করছে যত দ্রুত সম্ভব এই ভ্যাকসিন সংগ্রহ করতে। আর এখানেই সুযোগ তৈরি হয়েছে প্রভাব বিস্তারের।
ভার্জিনিয়া কমনওলেথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জুডি টুইগ বলেন, ‘দ্রুত ভ্যাকসিন পাওয়ার প্রশ্নে নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মধ্যে একটি মরিয়া ভাব তৈরি হয়েছে, যা পাই তাই নেব। যেখানে যা পাব নিয়ে নেব।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন কেনার জন্য মার্কিন সরকার এরই মধ্যে শত শত কোটি ডলার ব্যয় করেছে।
অর্থনীতি বিষয়ক সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের খবর অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অপারেশন ওয়ার্প স্পিড-এর আওতায় ৩০০ কোটি ডলার ব্যয়ে ভ্যাকসিন কেনার জন্য ছয়টি কোম্পানির সাথে চুক্তি করেছে।
মার্কিন স্বাস্থ্য ও মানব সেবামন্ত্রী অ্যালেক্স অ্যাজার বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র যে ভ্যাকসিন পাবে সেটা আগে দেশের জনগণের জন্য ব্যবহার করা হবে। তারপরই অন্য দেশে ভ্যাকসিন পাঠানোর কথা বিবেচনা করা হবে।
কিন্তু, কোনো দেশ মার্কিন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির থেকে ভ্যাকসিন কিনে নিতে চাইলে ট্রাম্প প্রশাসনের কোনো আপত্তি নেই বলে তিনি জানান।
তবে জো বাইডেনের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকার অন্য দেশের সাথে ভ্যাকসিন শেয়ার করার প্রশ্নে কী অবস্থান নেবেন তা এখনও পরিষ্কার নয়।
রাশিয়া
ভ্যাকসিন সরবরাহের প্রশ্নে অস্পষ্ট মার্কিন অবস্থান রাশিয়ার জন্য তৈরি করেছে ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের এক নতুন সুযোগ।
আরও পড়ুন: দেশে কোভিড ভ্যাকসিন বিতরণে মাস্টারপ্ল্যান হচ্ছে
ভারতে অনুমোদন পেল করোনার দুই ভ্যাকসিন
মস্কোর সরকার ঘোষণা করেছে যে ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ ২০টি দেশ তাদের তৈরি স্পুটনিক-ভি ভ্যাকসিনের আগাম চালান চেয়েছে।
সংবাদ সাময়িকী নিউ স্টেটসম্যানের এক খবরে বলা হয়, রুশ সরকারের বিনিয়োগ সংস্থা, রাশান ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড, স্পুটনিক-ভি টিকার শত শত কোটি ডোজ বিক্রির জন্য এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশের সাথে ডজন খানেক চুক্তি করেছে।
চীন
এই মহামারির সূত্রপাত চীন থেকে হয়েছে, তার জন্য গোড়ার দিকে যে দুর্নাম রটেছিল, বেইজিং সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় তা অনেকখানিই কমে গেছে।
সাংহাই গবেষণাগারের চীনা বিজ্ঞানীরা সরকারের প্রায় বিনা অনুমতিতেই কোভিড-১৯'র জিন সিকোয়েন্স বিশ্বের কাছে প্রকাশ করেছে।
এরপর বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইন ব্যবহার করে চীন নানা দেশে পিপিই সরঞ্জাম পাঠিয়েছে, যদিও এসবের গুনগত মান নিয়ে শুরুর দিকে অনেক প্রশ্ন উঠেছিল।কিন্তু মহামারি ছড়িয়ে পড়ার জটিল সময়ে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সেবার সাথে জড়িতদের সেগুলো খুবই কাজে লেগেছে।
ভ্যাকসিন গবেষণায় অগ্রগতির পথ ধরে চীনা কূটনীতিতে এক নতুন পর্যায় শুরু হয়েছে। যেমন, সিনোভ্যাক ইন্দোনেশিয়ার সরকারের সাথে 'প্রায়োরিটি অ্যাক্সেস' চুক্তি করেছে যার আওতায় এক কোটি ২০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন ইতোমধ্যেই সে দেশে পৌঁছে দেয়া হয়েছে এবং জানুয়ারি মাস শেষ হওয়ার আগেই আরও এক কোটি আট লাখ ডোজ সরবরাহের কথা রয়েছে।
এছাড়া জানুয়ারি মাসের শেষ নাগাদ ইন্দোনেশিয়ায় সাড়ে চার কোটি ডোজ ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য চীন সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
একই ঘটনা ঘটছে বিশ্বের অন্য প্রান্তেও। লাতিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ানের দেশগুলোর জন্য ১০০ কোটি ডলার অর্থমূল্যের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ এবং আফ্রিকার বেশ কিছু দেশেও চীন ভ্যাকসিন পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
দা আসিয়ান পোস্টের এক খবরে বলা হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় ভ্যাকসিন সরবরাহের লক্ষ্যে ই-কমার্স জায়ান্ট আলীবাবা এরই মধ্যে দুবাই এবং ইথিওপিয়ায় দুটি বিশাল সরবরাহ কেন্দ্র গড়ে তুলেছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাঁচটি দেশ-কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মিয়ানমারের সাথেও চীনের প্রায়োরিটি অ্যাক্সেস চুক্তি হয়েছে।
ভারত
গত বছর আগস্টে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন তখন ঢাকার সাথে শীতল হতে থাকা সম্পর্কে গতি আনার জন্য ঘোষণা করেছিলেন যে বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন দেয়া হবে।
ঢাকায় সাংবাদিকদের কাছে তিনি বলেন, ‘এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে যখন ভ্যাকসিন উৎপাদিত হবে তখন প্রতিবেশী, বন্ধু-দেশ এবং অন্যান্যরাও এর অংশীদার হবে।’
আরও পড়ুন: ভারত থেকে যথাসময়েই ভ্যাকসিন পাবে বাংলাদেশ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
জানুয়ারির মাঝামাঝিই ভ্যাকসিন পেতে পারি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
সেরামের টিকা পেতে সমস্যা হবে না: বেক্সিমকো
ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, শ্রিংলার ঢাকা সফরের আরেকটা উদ্দেশ্যও ছিল। সেটা হলো চীনের প্রভাব বলয় থেকে বাংলাদেশকে বাইরে রাখা।
এধরনের প্রতিশ্রুতি ভারত শুধু বাংলাদেশকেই দেয়নি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী দেশ হিসেব প্রতিবেশী নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা এবং আফগানিস্তানকেও ভারত অগ্রাধিকার দেবে বলে ঘোষণা করেছে।
এরই মধ্যে গত মাসে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে দিল্লিতে দায়িত্বরত ৬৪ জন বিদেশি কূটনীতিক হায়দ্রাবাদে দুটি ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী কোম্পানি-বায়োলজিক্যাল-ই এবং ভারত বায়োটেক ঘুরে এসেছেন।
তবে দা প্রিন্ট নামে দিল্লি-ভিত্তিক খবরের ওয়েবসাইট সরকারি সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে জানাচ্ছে, প্রতিবেশীদের কাছে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সরবরাহের কাজে ভারত 'তাড়াহুড়ো' করবে না।
হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন (এইচসিকিউ) উৎপাদন এবং সরবরাহের সময় ভারত যেমন সাবধানী ছিল, করোনার টিকা সরবরাহের ক্ষেত্রেও সেই 'এইচসিকিউ মডেল' ব্যবহার করা হবে বলে ওয়েবসাইটটি জানিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়া
দেশটির প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন জানিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়ার 'প্রশান্ত মহাসাগরীয় পরিবার' এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশীরা যাতে দ্রুত করোনা ভ্যাকসিন পায় তার জন্য তিনি কাজ করে যাচ্ছেন।
জাপান
চীনের 'হেলথ সিল্ক রোড' কূটনীতি প্রতিবেশী জাপানকেও ভাবিয়ে তুলেছে। ব্যবসা সংক্রান্ত ওয়েবসাইট নিকে এশিয়ার খবর অনুযায়ী, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনা প্রভাব ঠেকাতে টোকিওর সরকার গত আগস্ট মাসেই ১০০ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ দেয়ার কথা ঘোষণা করেছে। মেকং নদীর তীরবর্তী পাঁচটি দেশ এই অর্থ পাবে।