সিডর, আইলা, মহসিন, বুলবুল, আম্পান ও ইয়াসের মত ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস প্রতিনিয়ত আঘাত হানে উপকূলীয় খুলনা জেলার উপকুলীয় কয়রা উপজেলায়। ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছ্বাসের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয় উপকূলের মানুষের। প্রতি বছর যখনই ঝড় বন্যায় নদীর পানি বৃদ্ধি পায় তখন পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্বল বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপকূলের মানুষ। ভেসে যায় মৎস্য ঘের, ফসলি জমিসহ ঘর বাড়ি।
স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে সেই বাঁধ আবার নির্মাণ হয়। অনেক সময় পানি উন্নয়ন বোর্ড ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধে দায়সারা ভাবে কাজ করে। তবে দুর্বল বেড়িবাঁধ কখনোই টেকসই বেড়িবাঁধ হয়ে ওঠে না। বাধেঁর তদারকি না করায় আবারও ভেঙে প্লাবিত হয়। এমনই অভিযোগ উপকূলবাসীর।
উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মঠবাড়ি গ্রামের সুবোলের মোড় থেকে মঠবাড়ি পুলিশ ক্যাম্প পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেকু মেশিন দিয়ে মাটি তুলে নির্মাণ কাজ চলছে।
আরও পড়ুন: রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শক্তিশালী ভূমিকম্প
এলাকাবাসীর দেওয়া তথ্য মতে, ষাট দশকের দূর্বল বেড়িবাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় প্রতি বছর ঝড়, বন্যা, জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে, কোথাও বেড়িবাঁধ ভেঙে, কোথাও বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয় এলাকাবাসী। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদাসীনতায় আইলার এক যুগেও নির্মাণ করা হয়নি এই বেড়িবাঁধ। তাই নদী ভাঙ্গনের ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে এলাকাবাসীর অর্থায়নে শুরু হয়েছে বেড়িবাঁধের নির্মাণ কাজ।
মঠবাড়ি গ্রামের বিপুল সরকার বলেন, প্রতিবছর কোন না কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় আমাদের ঘর বাড়িসহ আমাদের আয়ের প্রধান উৎস মাছের ঘের। তাই আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে নিজেরা ঘের মালিকদের কাছ থেকে টাকা তুলে বাঁধের উপর মাটি দিয়ে বাঁধ মজবুত করার চেষ্টা করছি।
আরও পড়ুন: আবারও ভূমিকম্পে কেঁপে উঠলো সিলেট
২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বর নিরাপদ মন্ডল বলেন, ২০০৯ সালের ঘুর্ণিঝড় আইলার পর থেকে এখন পর্যন্ত কয়রা নদীর পাউবোর বাঁধের উপর পানি উন্নয়ন বোর্ড এক চাপ মাটিও দেয়নি। এবারে ইয়াসে বাঁধ উপচিয়ে ও ভেঙে মঠবাড়ি গ্রামের ৪ টা চর সহ পার্শ্ববর্তী মহারাজপুর গ্রাম প্লাবিত হয়ে গেছে। প্রতি বছর কোন না কোন দুর্যোগে প্লাবিত হয় আর এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে সেই বাঁধ নির্মাণ করে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদাসীনতায় আজও এই বেড়িবাঁধে মাটি দেওয়া হয়নি। এজন্য এলাকাবাসীর সম্মিলিত চেষ্টায় আমরা বাঁধটি মেরামত করছি।
মহারাজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘এলাকাবাসী নিজেদের অর্থায়নে যে রাস্তাটির কাজ করছে ওখানে পানি উন্নয়ন বোর্ড রাস্তার কাজ করার জন্য প্রস্তাবনায় রেখেছিলো। কিন্তু পাশ হওয়ার আগেই ঘুর্ণিঝড় ইয়াসে বাঁধ ভেঙে যায়। ওখানে একটা প্রকল্প দিয়ে এলাকাবাসীর অর্থ যাতে ফেরত দেওয়া যায় তার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছি।’
আরও পড়ুন: সপ্তাহের ব্যবধানে সিলেটে ফের ভূমিকম্প অনুভূত
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৩/১৪-১ নম্বর ফোল্ডারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, এলাকাবাসী নিজের অর্থায়নে কাজ করছে জানতে পেরে আমি সেখানে গিয়েছলাম। ওখানকার কাজের প্রস্তাবনা দেওয়া আছে। যেহেতু এলাকাবাসী কাজ করছে, এজন্য উপজেলা প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী স্যার বরাবর একটি আবেদন করার জন্য তাদেরকে বলা হয়েছে। আমাদের অফিসের নিয়মানুযায়ী সেখানে একটা প্রকল্প দিয়ে এলাকাবাসীর টাকা ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।
আরও পড়ুন: জলোচ্ছ্বাসে ডুবেছে সুন্দরবন, ভেসে আসছে বন্য প্রাণী
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাসেদুল ইসলাম বলেন, ‘জনগণ নিজেরা কাজ করছে এটা আমার জানা নেই। আর যদি কাজ করে থাকে সেখানে আমরা এই সময়ে কাজ করবোনা।’
এদিকে আইলা, সিডর, আম্পান তারপর ইয়াস, উপকুলীয় জনপদ কয়রাকে ছিন্নভিন্ন, বিপন্ন, বিপর্যস্ত করেছে। মানবতার চরম বিপর্যয় ঘটিয়েছে, প্রকৃতির রুদ্রমুর্তি ছিল সিডর, আইলা আর আম্ফানে কিন্তু সদ্য আবির্ভূত হয়ে শেষ হওয়া ইয়াসের রুদ্রমূর্তি থাকলেও বিপন্নতা আর জন মানুষের চরম ক্ষয়ক্ষতির দোরগোড়ায় নিয়েছে। উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দী জীবন যাপন করছে।
আরও পড়ুন: বন্যপ্রাণী হত্যা ও পাচার রোধে সুন্দরবনে রেড এ্যালার্ট
আম্পানের ক্ষত শুকায়নি দক্ষিণ বেদকাশি, উত্তর বেদকাশি ও কয়রা সদরের বিস্তীর্ণ জনপদে, তার উপর গত ২৬ মে ইয়াস, কয়রা বরাবরই দুর্যোগ প্রবন এলাকা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ দুর্বিপাকে সর্ব প্রথম আঘাত হানে বেড়িবাধগুলোতে, কিন্তু বাস্তবতা হলো সাতক্ষীরার পানি উন্নয়ন বোর্ড কয়রাবাসীকে রক্ষার মূলস্তম্ভ বেড়িবাঁধগুলোর যথাযথ সংরক্ষন, সুদৃঢ়, মজবুত ও টেকসই করেনি, যার খেসারাত দিতে হচ্ছে লাখ লাখ মানুষের।
কেবল জীবন যাত্রায় বিপন্নতা নয়, অর্থনীতিতেও নেমে এসেছে দুরবস্থা। বাঁধ ভেঙ্গে গ্রামের পর গ্রামে প্রবেশ করেছে নদী আর সাগরের লবণাক্ত পানি যা জনসাধারণের বসত ঘর, রান্না ঘর ছুইছে। গবাদী পশু আর মানুষ একই সাথে বসবাস করছে। সাপ, ব্যাঙ, মাছ আর মানুষ একই বৃত্তে দিন ও রাত যাপন করে চলেছে।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করা যায়নি, অর্থাৎ ঝড় বা ব্যাপক ঝড় বাতাস প্রত্যক্ষ করা যায়নি কিন্তু পানি প্রবাহের অবিরাম অনুপ্রবেশ, একের পর এক বাঁধ ভেঙ্গে জনপদ প্লাবিত হওয়া যেন জীবনের সাথে জীবনের যুদ্ধাবস্থা।
কোটি কোটি টাকার চিংড়ি ভেসে গেছে, ঘের ব্যবসায়ীদের একটি অংশ পথে বসতে চলেছে। গত কয়েক দিন যাবৎ নদী সংলগ্ন ঘেরগুলোতে জোয়ারের সময়ে পানি প্রবেশ করছে ভাটায় নেমে যাচ্ছে। অনেক ঘের ব্যবসায়ীরা মওসুমের প্রথম চালানের চিংড়ি বাজারজাত করতেও পারেনি। কেবল চিংড়ি নয় ভেসে গেছে কোটি কোটি টাকার সাদা প্রজাতির মাছ।
সম্প্রতি ২/১ বছর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক ভাবে সাদা প্রজাতির মাছ চাষ হচ্ছে। চিংড়ি ঘেরগুলোতে আষাঢ়, শ্রাবণ মাসে পানির লবণাক্ততা হ্রাস পেলে সাদা প্রজাতির মাছ ছাড়া হয়, আর সেই পরিস্থিতিতে সাদা মাছ চাষে বিশেষ বিপ্লব হয়েছে। কিন্তু সর্বনাশ ইয়াস আর দুর্বল, অরক্ষিত বেড়িবাধ ভেঙ্গে যাওয়ায় চাষীদের স্বপ্ন আর অর্থ দুটোই সর্বশান্ত হয়েছে।
বীজতলায় পানি জমেছে, নানান ধরনের রবিশষ্য, কাটা খদ নষ্ট হয়েছে দক্ষিণ বেদকাশি, উত্তর বেদকাশি, কয়রা সদর, মহারাজপুর আর বাগালী ইউনিয়নে। মানুষের কান্না, আতঙ্ক আর উদ্বেগে একাকার। চেষ্টা করছে বেঁচে থাকবার, আর তাই স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বেড়িবাঁধ নির্মানে দিন রাত কাজ করছে জনসাধারণ। যত ক্ষোভ আর অনিষ্টের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডকে।
জনসাধারণের এই চরম দুঃসময়ে কেবল উচ্চারণ হচ্ছে বেড়িবাঁধ না ভাঙ্গলে এমন ক্ষতি হতো না।
উপকুলীয় এলাকার সর্বশান্ত মানুষগুলোর বারবার উচ্চারণ তারা ‘ত্রাণ নয় তারা চায় টেকসই বাঁধ, যে বাঁধ নদীর উত্তাল স্রোতধারাকে রোধ করবে, প্রকৃতির হিংস্রতাকে প্রতিহত করবে। বারবার অর্থ বরাদ্ধ হয়, ভাঙ্গনরোধে কাজ হয়, কিন্তু বাস্তবতা হলো সেই কাজ কতটুকু টেকসই, মজবুত ও স্থায়ী বাঁধের জন্য যথাযথ?
কয়রা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ভাংগন রোধে দৃশ্যত স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজ চলছে। কয়রা উপজেলা প্রশাসন ভাঙ্গন কবলিত, পানি বন্দী মানুষের পাশে থাকছেন। বিশেষ করে বাঁধ নির্মাণে সশরীরে উপস্থিত থাকছেন।
উপকুলীয় এ জনপদ কয়রার সর্বস্তরের মানুষের প্রত্যাশা কয়রা উপজেলা প্রশাসন যন্ত্র সরকারের উচ্চমহলকে অবহিত করবেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বহীনতায় উপজেলাবাসী কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত এবং স্থায়ী বাঁধ নির্মাণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।