শেরপুরের শ্রীবরদী সীমান্তে আবারও বন্য হাতির আনাগোনা শুরু হয়েছে। ক্ষেতের ফসল পাকতে শুরু করতেই বন্যহাতির দল লোকালয়ে নেমে এসে হানা দিচ্ছে আবাদী জমিতে। গত এক সপ্তাহ ধরে হাতির দল খেয়ে সাবাড় করছে, পায়ে মাড়িয়ে নষ্ট করছে খেতের আধপাকা ধান, সীম-বরবটি, করলাসহ নানা ধরনের সবজীর আবাদ।
মূলত: খাবারের সন্ধানেই বন্য হাতির দল লোকালয়ে নেমে আসছে। হাতি তাড়াতে রাত জেগে জান-মাল রক্ষার চেষ্টা করছেন সীমান্ত অঞ্চলের অধিবাসীরা। এতে হাতি আতঙ্কে ঘুম নেই স্থানীয় পাহাড়ি অধিবাসীদের।
স্থানীয়রা জানান, ভারতের সীমানাঘেঁষা শেরপুরের শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় গারো পাহাড়ের প্রায় ৪০টি গ্রাম রয়েছে। ওইসব গ্রামের চারপাশ ঘিরে গারো পাহাড়। কয়েকদিন যাবত ভারত থেকে নেমে আসা শতাধিক বন্য হাতি কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে ওইসব এলাকায় বিচরণ করছে। বন্য হাতির দল সারাদিন পাহাড়ি ঝোপ-জঙ্গলে থাকলেও সন্ধ্যা হলেই নেমে আসে লোকালয়ে। হামলা চালাচ্ছে বাড়ি-ঘরে। খেয়ে সাবাড় করছে চলতি আমন মৌসুমের আবাদ। পা দিয়ে মাড়িয়ে নষ্ট করছে বিস্তীর্ণ আবাদি জমির ফসল। আর ধ্বংস করছে সবজি খেত। বাধা দিতে গেলে শুরু হয় হাতি ও মানুষের যুদ্ধ। ঢাকঢোল পিটিয়ে, পটকা ফুটিয়ে আর মশাল জ্বালিয়ে ঠেকানো যাচ্ছে না হাতির তান্ডব। এখন ওইসব গ্রামের অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ হাতির আতঙ্কে দিন পার করছেন।
৩১ অক্টোবর রবিবার সরেজমিনে শ্রীবরদীর বালিজুড়ি এলাকায় গেলে কথা হয় স্থানীয় গারো কৃষক ব্রতীন মারাকের সাথে। তিনি জানান, আমরা পাহাড়ে বসবাস করি। এখানকার প্রায় সবাই কৃষির ওপর নির্ভরশীল। বন্য হাতি খেতের সবজি আর ধান খেয়ে সাবাড় করছে। মাঝেমধ্যে বাড়ি-ঘরেও হামলা করছে। এ ব্যাপারে শ্রীবরদী থানায় পৃথকভাবে অনেকে সাধারণ ডায়েরিও করেছেন।
আর পড়ুন: শেরপুরে বন্যহাতির আক্রমণে গারো অধিবাসী নিহত
নেয়াবাড়ির টিলা ও পার্শ্ববর্তী মালাকোচা গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক রহুল আমীন, মজনু মিয়া, আলাল মিয়া, আশরাফুল ইসলাম বলেন, আমরা পাহাড়ের বাসিন্দা। ধান আর সবজি চাষ করি। এসব ফসলের আয় দিয়েই আমাদের সংসার চলে। প্রতিবছরই ধান পাকলেই হাতি আসে। সবজি আর ধানক্ষেত খাইয়া যায়। অনেক ক্ষতি করতাছে। এইবারও অনেক ক্ষতি করছে। এখন বউ পোলাপান নিয়া ক্যামনে চলমু, চিন্তায় আছি।
শ্রীবরদী উপজেলা সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সাধারণ সম্পাদক শাহ মো. কোহিনুর হোসেন বলেন, আমরা একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য মতে, জানতে পেরেছি, এই পাহাড়ে ১৯৯৫ সাল থেকে বন্য হাতির আক্রমণ চলছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৭০ জন মানুষ মারা গেছেন। আহত হয়েছেন শত শত। ক্ষতি হয়েছে বিস্তীর্ণ আবাদি জমির ফসল। বন্যহাতির তান্ডব থেকে মানুষের জান-মাল রক্ষায় স্থায়ী পদক্ষেপ দরকার।
শ্রীবরদী উপজেলা ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান প্রাঞ্জল এম সাংমা বলেন, গারো পাহাড়ে বেশির ভাগ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজনের বসবাস। গ্রামবাসী হাতির উপদ্রব থেকে বাঁচতে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে। তবে এখনো প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্থায়ী কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এ জন্য দিন দিন বন্য হাতির তান্ডবে ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে।
আরও পড়ুন: বান্দরবানে বন্য হাতির আক্রমণে প্রাণ গেল ২ কিশোরের
এ ব্যাপারে শ্রীবরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিলুফা আক্তার বলেন, আমরা বন্য হাতির হামলায় নিহত, আহত ও ঘরবাড়িসহ ফসল ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে আসছি। তাছাড়া বন্যহাতি তাড়াতে মশাল জ্বালানোর জন্য এলাকাবাসীর মাঝে কেরোসিন তেল ও জেনারেটর চালাতে ডিজেল সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া স্থায়ীভাবে বন্য হাতির কবল থেকে রক্ষা পেতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জোরালো হস্তক্ষেপের কথা জানানো হয়েছে। খুব দ্রুতই পদক্ষেপ নেয়া হবে।
বনবিভাগের শেরপুরের এসিএসফ (সহকারি বন সংরক্ষক) ড. প্রাণতোষ চন্দ্র রায় বলেন, পাহাড়ি অঞ্চলে হাতি-মানুষে দ্বন্দ্ব নিরসনে সহাবস্থান নিশ্চিত করতে বনবিভাগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এলাকায় এলাকায় এলিফেন্ট রেসপন্স টিম গঠন করে তাদেরকে প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। যাতে লোকালয়ে আসা বন্যহাতিকে উত্যক্ত না করে কিভাবে তাদেরকে ফের বনে ফেরত পাঠানো যায়। বন্যহাতির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণও দেয়া হচ্ছে। বনের ভেতর সুফল প্রকল্পের মাধ্যমে হাতির খাবার উপযোগী বনবাগান সৃষ্টিরও চেষ্টা করা হচ্ছে। যাতে বন্যহাতি খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে না আসে।
আরও পড়ুন: চট্টগ্রামে হাতির আক্রমণে নিহত ৩ পরিবার পাবে একলাখ টাকা করে