বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত নাওকি ইতো দু'দেশের বহুমুখী সহযোগিতার দৃঢ় অংশীদারিত্ব উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করার জন্য পাঁচটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছেন।
রাষ্ট্রদূত বলেছেন,এই পাঁচ চ্যালেঞ্জ হলো- বাংলাদেশ-জাপান কৌশলগত অংশীদারিত্ব উন্নয়ন করা, বাংলাদেশকে বিনিয়োগের জন্য আরও আকর্ষণীয় করা, জনগণের মধ্যে বিনিময় সম্প্রসারণ, অবাধ ও মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশের সাথে সহযোগিতা বাড়ানো এবং এই অঞ্চলে ও এর বাইরে বাংলাদেশের সম্মান বাড়ানোর জন্য প্রচেষ্টা জোরদার করা।
রবিবার কসমস গ্রুপ আয়োজিত এক অনলাইন সংলাপে রাষ্ট্রদূত ইতো বলেন, ‘আমাদের এগিয়ে যাওয়া দরকার। আমি মনে করি আমাদের সম্পর্ক প্রাকৃতিকভাবে প্রতিটি এজেন্ডার মাধ্যমে গভীরতর হবে।’
কসমস গ্রুপের জনহিতকর প্রতিষ্ঠান কসমস ফাউন্ডেশন ‘বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ক: ভবিষ্যতের পূর্বাভাস’ শীর্ষক সংলাপটি আয়োজন করে। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ও জাপান আগামী বছর কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন করবে।
সংলাপে উদ্বোধনী বক্তব্য দেন কসমস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এনায়েতুল্লাহ খান। সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত কূটনীতিক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী।
আলোচক প্যানেলে ছিলেন ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের বিশেষ দূত মো. আবুল কালাম আজাদ, জাইকা বাংলাদেশ অফিসের প্রধান প্রতিনিধি হায়াকাওয়া ইউহো, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, টোকিও’র স্যাক্রেড হার্ট বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক মাসাকা ওহাশি, সাংবাদিক ও লেখক মনজুরুল হক, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব পাবলিক পলিসির ডীন অধ্যাপক তাকাহারা আকিও এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত তারিক এ করিম।
রাষ্ট্রদূত ইতো বলেন, ‘দু’দেশের উচিত সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা উপভোগ করা এবং আরও উন্নত করার জন্য সচেতন এবং প্রাণান্তকর চেষ্টা করা। আমাদের নিজেদের সম্পর্কে আত্মতুষ্ট হওয়া উচিত নয়।’
তিনি বলেন, “২০২২ সাল অংশীদারিত্বকে আরও উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করার জন্য একটি চমৎকার সুযোগ প্রদান করবে এবং আমি আশাবাদী যে দুটি দেশই এই অংশীদারিত্বকে ‘সত্যিকারের কৌশলগত অংশীদার’ হিসেবে অভিহিত করতে পারবে।”
রাষ্ট্রদূত ইতো বলেন, বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথের (বিগ-বি ইনিশিয়েটিভ) অধীনে মানসম্মত অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং যোগাযোগ জোরদারকরণ কেবল বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্যই নয়, আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যও উপকারী হবে।
তিনি বলেন, ‘এই বিগ-বি কেবল বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য নয়, সমগ্র বে অব বেঙ্গল অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
এনায়েতুল্লাহ খান বলেন, ‘জাপানের ভূ-কৌশলগত ভূমিকা ও অবস্থান এবং বাংলাদেশের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি এখনও বিশ্বস্ত রয়েছে, যা বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।’
তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় বাংলাদেশ-জাপান বন্ধুত্ব কেবল পারস্পরিক স্বার্থের জন্য নয়, মূলত খাঁটি সহানুভূতিরই একটি অংশ।’
প্রখ্যাত জাপানি চিত্রশিল্পী হোকুসাইয়ের আঁকা ফুজি পাহাড়ের ৩৬টি দৃশ্য বাংলাদেশ-জাপানের সর্ম্পককে মনে করিয়ে দেয় বলে এনায়েতুল্লাহ খান উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, জাপান বাঙালির অন্তরে জায়গা করে নিয়েছে এবং এই সম্পর্কের ভিত্তি বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলোতেই অর্জন করেছে।
আরও পড়ুন: কসমস সংলাপ: ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রত্যাশা
এনায়েতুল্লাহ খান আরও বলেন, এশিয়া মহাদেশের ভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে বেশ কয়েকটি আকর্ষণীয় মিল রয়েছে।
তিনি বলেন, উভয় পক্ষই সামনের দিনগুলোতে এই সম্পর্ক থেকে বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্র এবং জনগণের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সুফল পাওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে পারে।
ড. ইফতেখার আশা প্রকাশ করেন যে দু'দেশই তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে একসাথে কাজ করে যাবে। পররাষ্ট্র বিষয়ক এই বিশেষজ্ঞ বলেন, জাপান সর্বদা বাংলাদেশের পাশে রয়েছে।
ড. ইফতেখার আরও বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে উঠে আসার ক্ষেত্রে জাপান চমৎকার বাণিজ্যিক অংশীদার। তিনি বলেন, ‘দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমি স্পষ্টতই বলতে পারি যে বাংলাদেশ এখন যেখানে পৌঁছেছে তার একটি বড় কারণ জাপান সর্বদা আমাদের পাশে রয়েছে।’
ড. ইফতেখার বলেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ছাড়াও জাপান বরাবরই এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের তহবিল বাংলাদেশের জন্য সহজতর করেছে।
আবুল কালাম আজাদ বলেন, ২০১৪ সালে শুরু হওয়া পিপিইডি (পাবলিক-প্রাইভেট ইকোনমিক ডায়লগ) জাপানের সহযোগিতায় বাংলাদেশের উন্নয়নে এক নতুন যুগের ভিত্তি।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে প্রায় ৮০টি জাপানি কোম্পানি বাংলাদেশে ছিল। বর্তমানে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে ৩৪০টিরও বেশি জাপানি কোম্পানি। পিপিইডি অনুসরণ করেই এই অর্জন এসেছে।
আজাদ বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, আমরা যে পতাকা বহন করছি, জাপান এবং বাংলাদেশের একই পতাকা রয়েছে, সে যাত্রা আরও ত্বরান্বিত হবে।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বাস করে যে, জাপানের মতো ঘনিষ্ঠ বন্ধু সর্বদা বাংলাদেশের সাথে থাকলে বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রার গতি ত্বরান্বিত হবে।
হায়াকাওয়া ইউহো বলেন, দু'দেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করতে জাইকা বাংলাদেশের উন্নয়নে কার্যকর সহযোগিতা দেবে। তিনি বলেন, ‘আমি আত্মবিশ্বাসী যে জাইকা বিশেষ অংশীদার হিসেবে সবসময় পাশে থাকবে। বাংলাদেশের জনসাধারণের বিনিয়োগ প্রকল্পগুলোকে সহায়তা করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।’
পড়ুন: কসমস সেন্টারে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে প্রদর্শনী দেখলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত
তিনি আরও বলেন, জাইকা অন্যান্য মধ্যম আয়ের দেশগুলোর সাথে পরিবেশগত উন্নতি, উচ্চশিক্ষা, বয়স্ক সমাজের জন্য প্রস্তুতি, প্রতিবন্ধীদের জন্য সহায়তা, শিল্প বৈচিত্র্যকরণ এবং বেসরকারি বিনিয়োগ একত্রিতকরণের মতো ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করে যাচ্ছে।
ইউহো বলেন, ডিজিটাল রূপান্তরকে কাজে লাগানোর জন্যও আমাদের সহযোগিতা বাড়াতে হবে। আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি যে বাংলাদেশেও এই নতুন ক্ষেত্রে সহায়তার প্রয়োজনীয়তা বাড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, তিনি জাপানের প্রতি মুগ্ধ, কারণ দেশটি সর্বদা বাংলাদেশের বন্ধু। তিনি বলেন, ‘জাপান শুধুমাত্র সেতুর মতো অবকাঠামোগত উন্নয়নই নয়, বাংলাদেশে দক্ষতা বিকাশের ক্ষেত্রেও অসামান্য ভূমিকা পালন করে আসছে।’
সাবেক এই গভর্নর বলেন, জাপান তহবিল দেয়ার পাশাপাশি জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ভাগ করে বাংলাদেশের মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে জোর দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাকে বলতেই হবে যে কৃষিক্ষেত্রে বিশেষ করে কুমিল্লা একাডেমি এবং অন্যান্য অনেক উপায়ে জাপান প্রচুর অবদান রেখেছে। এটি যথেষ্ট পরিমাণে সহায়তা। শুধু আর্থিক দিক থেকে এই অবদানগুলো পরিমাপ করতে পারবেন না।’
আর্থিক সহায়তার বিষয়ে সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘জাপান সব ঋণকে অনুদানে পরিণত করে একটি দুর্দান্ত কাজ করে। এটি কেবল আমাদের সেতু এবং অবকাঠামো তৈরি করতে সহায়তা করছে না বরং আমাদের অবস্থানকেও সমৃদ্ধ করছে ।’
বঙ্গোপসাগর এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অঞ্চলে পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশকে নতুন ধরণের কূটনীতির মাধ্যমে তার অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়টি লক্ষ্য করা উচিত। তিনি বলেন, ‘জাপান এবং বাংলাদেশের মধ্যে কারিগরি ও সামাজিক উন্নয়নের উভয় দিকে যোগাযোগ বাড়াতে হবে।’
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এখনও নিম্নপর্যায়ে রয়েছে উল্লেখ করে ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘এটি বিকেন্দ্রীকরণ ও উন্নত করা উচিত। জাপান এ ক্ষেত্রে আমাদের সহায়তা করতে পারে কারণ আমি তাদের হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা দেখেছি।’
অধ্যাপক ওহাশি বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে এনজিও- জনগণ পর্যায়ে সহযোগিতা এবং বিনিময় প্রত্যাশা করেন। তিনি বলেন, সর্বজনীন মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য নিজ নিজ দেশে সুশীল সমাজের উপযুক্ত স্থান নিশ্চিত করতে হবে।
পড়ুন: গ্যালারি কসমসের মাসব্যাপী ভার্চুয়াল চিত্র প্রদর্শনী ‘দ্য ব্ল্যাক স্টোরি’ শুরু
মনজুরুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশের সাথে জাপানের সম্পর্ক এই অর্থে অনন্য যে এই বন্ধন কখনই বিতর্কিত হয়নি। ১৯৭৩ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফরের পর দু'দেশের সম্পর্কে এক নতুন মাত্রা পেয়েছিল। আমরা অনেক সমস্যার মুখোমুখি হলেও জাপানের সাথে এক সাথে কাজ করে এগিয়ে যাচ্ছি।’
অধ্যাপক তাকাহারা আকিও আশা প্রকাশ করেন যে জাপান ও বাংলাদেশ এই অঞ্চলে আরও বেশি আকর্ষণীয় সম্পর্ক তৈরি করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। তিনি বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এটি সম্ভব। এই সংলাপ পারস্পরিক বোঝাপড়া আরও বাড়িয়ে তুলবে এবং আমাদের ভালো সহযোগিতার ভিত্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক অবদান রাখবে।
তারিক এ করিম বলেন, ‘আমরা প্রায় একই অবস্থানে আছি। জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে একটি কঠিন জায়গায় রয়েছে। আমরাও ভারত এবং চীন এবং এখন দুটি ন্যারেটিভের মধ্যে: ইন্দো প্যাসিফিক এবং বিআরআইয়ের মধ্যে একটি কঠিন জায়গায় আছি।’
সাবেক এই কূটনীতিক জানান, তিনি ব্যক্তিগতভাবে উভয়ের সাথে সুসম্পর্ক এবং উভয়ের সাথে সক্রিয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে কোনও দ্বন্দ্ব দেখতে পান না। তিনি বলেন, তাদের মূলত পরবর্তী ১০ বছর বা ২৫ বছরের দিকে নজর দেয়া উচিত এবং তাদের পরিপূরকতা কোথায় এবং কীভাবে তারা এই পরিপূরকগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে এবং গড়ে তুলতে পারে তা চিহ্নিত করতে হবে।
কসমস ফাউন্ডেশনের এই অনুষ্ঠানটি এর আগে ‘অ্যাম্বাসেডরস লেকচার সিরিজ’ নামে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতো। মহামারির কারণে এখন অনলাইনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে এ জাতীয় ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ দিক এবং ইস্যুতে গঠনমূলক আলোচনার জন্য কসমস ফাউন্ডেশনের এ জাতীয় আরও ওয়েবিনার আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে।