রবিবার দুপুরে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. শওকত হোসাইন এ রায় দেন।
এ রায়ে ৬ আসামির ফাঁসি, ৪ আসামির যাবজ্জীবন ও ৩ আসামির বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। বাকি ৪০ আসামিকে খালাস দেয়া হয়েছে।
অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান মুন্সী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও জেলা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ছিলেন এবং তার ভাই মনির হোসেন মুন্সী শরীয়তপুর পৌরসভা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
মামলায় মোট আসামি ছিলেন ৫৩ জন। ফাঁসি ও যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে ১৩ জনকে সাজা এবং ৪০ জনকে খালাস দেয়া হয়েছে ।
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন, শহীদ কোতোয়াল (৫০), শাহীন কোতোয়াল (৪৬), শফিক কোতোয়াল (৪০), মজিবর তালুকদার (৫২), শহীদ তালুকদার (৪০) ও সলেমান সরদার (৪৮)।
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন, বাবুল তালুকদার (৫৫), বাবুল খান (৫৬), ডাবলু তালুকদার (৪৯) ও রশিদ (৪২)।
দুই বছর সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন, মন্টু তালুকদার (৪৫), মজনু তালুকদার (৪৯) ও আসলাম সরদার (৫২)।
রায়কে ঘিরে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে আদালত প্রাঙ্গণে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়।
এদিকে রায় প্রত্যাখান করে শহরের প্রধান সড়ক ও বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে শরীয়তপুরের সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেছে অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান মুন্সী ও মনির হোসেন মুন্সী সমর্করা।
মামলার এজাহার ও বাদীর পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শরীয়তপুর-১ (পালং-জাজিরা) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন জাজিরা উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান মোবারক আলী সিকদার এবং বিদ্রোহী (স্বতন্ত্র) প্রার্থী ছিলেন হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ। তখন স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি অংশ বিদ্রোহী প্রার্থী আওরঙ্গের পক্ষে অবস্থান নেন। ১ অক্টোবরের ওই নির্বাচনে সহিংসতার কারণে জাজিরা উপজেলার কয়েকটি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয় এবং পরবর্তী ৮ অক্টোবর স্থগিত হওয়া কেন্দ্রে পুনরায় ভোট গ্রহণের দিন ধার্য করে নির্বাচন কমিশন। ৫ অক্টোবর নৌকার পক্ষে শহরের নিজ বাড়িতে নেতা-কর্মীদের নিয়ে সভা করছিলেন অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান। ওই সভায় বিদ্রোহী প্রার্থী আওরঙ্গ'র সমর্থক আওয়ামী লীগের একটি বিদ্রোহী গ্রুপ অতর্কিত গুলিবর্ষণ করে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন অ্যাড. হাবিবুর রহমান ও তার ভাই মনির মুন্সী।
আরও পড়ুন: শরীয়তপুরে ছেলের ‘কুঠারঘাতে’ মায়ের মৃত্যু
পুলিশ ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনায় হাবিবুর রহমানের স্ত্রী জিন্নাত রহমান বাদী হয়ে আওরঙ্গসহ মোট ৫৫ জনকে আসামি করে পালং থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং বিএনপি সরকার গঠন করে। ২০০৩ সালে সংসদ সদস্য আওরঙ্গ'র নাম বাদ দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। মামলার বাদী তখন আদালতে নারাজি দেন। আদালত ওই আবেদন নামঞ্জুর করেন। এরপর বাদী উচ্চ আদালতে রিট করেন। ২০১৩ সালের ৩ আগস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় আওরঙ্গ মারা যান। এরপর উচ্চ আদালত মামলাটি পুনরায় তদন্ত করে পুলিশকে অভিযোগপত্র দাখিলের নির্দেশ দেন। আওরঙ্গ সহ তিন আসামি মারা যাওয়ায় পুলিশ তদন্ত করে ২০১৩ সালের অক্টোবরে ৫৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
এরপর চার্জ গঠন করে মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। ২৮ জন স্বাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক শোনা হয়। কয়েক দফায় রায়ের তারিখ পেছানোর পরে অবশেষে বহুল আলোচিত চাঞ্চল্যকর জোড়া খুনের রায় ঘোষণা করেন আদালত।
আরও পড়ুন: শরীয়তপুরে প্রতিপক্ষের গুলিতে যুবক নিহত, গুলিবিদ্ধ আরও ২
অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান মুন্সীর বড় ছেলে অ্যাডভোকেট পারভেজ রহমান জন শরীয়তপুর পৌরসভার নবনির্বাচিত মেয়র ও জেলা জজ আদালতের এপিপি।
তিনি বলেন, ‘আমার বাবা ও চাচা হত্যার সাথে সরাসরি জড়িতদের বিরুদ্ধে আমরা আদালতে প্রমাণ হাজির করতে পেরেছি। আমাদের আশা ছিল তাদের ফাঁসির রায় হবে। কিন্তু তাদের অনেককে সাজা কমিয়ে দেয়া হয়েছে এবং অনেককে খালাস দেয়া হয়েছে। আমরা এই রায়ে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করব।’
শরীয়তপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মীর্জা মো. হজরত আলী বলেন, ‘দুই ঘণ্টা যুক্তিতর্কের পর এ রায় ঘোষণা করেন বিচারক। মামলাটি গত ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর প্রথম সাক্ষী গ্রহণ শুরু করে। মামলায় বাদী পক্ষের ২৮ জন ও আসামি পক্ষের ২৫ জন সাক্ষ্য দেন। বর্তমানে ৫২ জন আসামির মধ্যে ২৬ জন জেল হাজতে, ১৩ জন জামিনে ও ১৩ জন পলাতক রয়েছেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাসুদুর রহমান বলেন, ‘এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট নই। আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব।’
আরও পড়ুন: শরীয়তপুরে গৃহবধূকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় ৩ জনের মৃত্যুদণ্ড