করোনাভাইরাসের উদ্বেগজনক সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে সপ্তাহের শুরুর দিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের (পিএমও) জারি করা ১৮ দফা নির্দেশনাগুলো কার্যকর করার লক্ষ্যে কঠোর অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত নিযেছে সরকার।
বৃহস্পতিবার করোনায় দেশে একদিনে সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৪৬৯ শনাক্ত এবং এর আগে টানা কয়েকদিন সংক্রমণ ৫ হাজারের বেশি হওয়ায় এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ইউএনবিকে জানিয়েছন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সকল মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানে ৫০ শতাংশ জনবল দিয়ে অফিস কার্যক্রম শুরু হবে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, সকল মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই নির্দেশনা অনুসরণ করতে কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: করোনায় দেশে একদিনে সর্বোচ্চ ৬৪৬৯ শনাক্ত, মৃত্যু ৫৯
তিনি বলেন, আমরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ নির্দেশনা বুধবার থেকেই বাস্তবায়ন শুরু করেছি। বৃহস্পতিবার থেকে অন্যান্য সকল মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানগুলো নির্দেশনা বাস্তবায়ন শুরু করেছে। প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি ডিউটি রোস্টার করে দিবে। অর্ধেক কর্মকর্তা-কর্মচারী তিনদিন অফিসে এসে কাজ করবেন এবং দুই দিন বাসায় থেকে কাজ করবেন। বাকিরাও দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে এই নিয়মে কাজ করবেন।
গর্ভবতী নারী, ৫৫ বছরের বেশি বয়স, অসুস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা আছেন তারা বাসা থেকে অনলাইনে কাজ করবেন।
প্রতিমন্ত্রী জানান, এছাড়াও বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠান এবং অফিসগুলোতে ৫০ শতাংশ কর্মী অফিসে এসে এবং বাকিরা অনলাইনের মাধ্যমে কাজ করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, মাঠ পর্যায়েও আমরা মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করছি। অপ্রয়োজনে কেউ যাতে রাত ১০টার পর বাইরে না যায়, সেটি আমরা নিশ্চিত করব। এ বিষয়ে আমাদের পুলিশ প্রশাসন কাজ করবে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘দুই সপ্তাহ পর্যন্ত আমরা এ সিদ্ধান্তগুলো পালন করব এবং ১২ এপ্রিলের পর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় জানায়, সোমবার ১৮ দফা নির্দেশনা জারির পর করোনার সংক্রমণ রোধে ইতিমধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে সরকারের দেয়া নির্দেশনাগুলো জনসাধারণ ও সংশ্লিষ্টদের মেনে চলতে কর্ম-পরিকল্পনা তৈরি করেছে পুলিশ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ইউএনবিকে বলেন, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশ চেকপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে এবং পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছে।
আরও পড়ুন: করোনা: সিলেটে ১১টি বিধি-নিষেধ জারি করল জেলা প্রশাসন
এছাড়াও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, স্বাস্থ্য নির্দেশনা বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখার জন্য প্রশাসন সব কিছু করবে।
তিনি আরও বলেন, যেভাবে প্রতিদিন করোনা আক্রান্তের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে এভাবে চলতে থাকলে দেশে কোন হাসপাতালেই রোগী রাখার জায়গা থাকবে না। এজন্য করোনা বৃদ্ধি ঠেকাতে এখনই দলমত নির্বিশেষে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ১৮ দফা নির্দেশনার যথাযথ বাস্তবায়নসহ সকল স্থানে স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে চলতে না পারলে আগামীতে এই প্রকোপ ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।’
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আবদুল মান্নান জানিয়েছেন, তারা ইতোমধ্যে কঠোরভাবে স্বাস্থ্য নির্দেশনা অনুসরণ করতে শুরু করেছেন।
আরও পড়ুন: করোনা: অনির্দিষ্টকালের জন্য মিরপুর ও রংপুর চিড়িয়াখানা বন্ধ
পরিবহনে বিধিনিষেধ
রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন ইউএনবিকে বলেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণ রোধে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশ রেলওয়ে ট্রেনের ৫০ শতাংশ আসন খালি রেখে বুধবার থেকেই ৫০ শতাংশ টিকিট বিক্রির কার্যক্রম শুরু করেছে।
মন্ত্রী বলেন, ‘৫০ শতাংশ টিকিটের মধ্যে অর্ধেক বিক্রি হবে অনলাইনে এবং বাকি অর্ধেক বিক্রি হবে স্টেশন থেকে। আমরা এর আগেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ট্রেন পরিচালনা করেছি। এবারও সরকারের নির্দেশনা শতভাগ নিশ্চিত করতে কাজ শুরু করেছি । স্বাস্থ্যবিধি না মেনে আমরা কোন যাত্রী পরিহন করব না । প্রতিটি ট্রেন ও স্টেশনে স্বাস্থ্যবিধি মানতে যা যা করার দরকার তাই করব।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিবস খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ইউএনবিকে বলেন, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ঢাকাসহ সারা দেশে ৫০ শতাংশ যাত্রী পরিবহন শুরু করেছি। প্রতিটি বাস স্প্রে করা হচ্ছে ও পরিষ্কার রাখা হচ্ছে।
বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার ইউএনবিকে বলেন, সরকারের নির্দেশনা কার্যকরের লক্ষ্যে বুধবার থেকে বিআরটিএ সব ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। যদি কোন বাস নির্দেশ না মানে তাহলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।
নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালেদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মেনে নৌ যান চলাচল করবে। নৌযানেও ৫০ শতাংশ যাত্রী পরিহন করা হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাত্রীরা লঞ্চে উঠবে। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ ‘র চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান ইউএনবিকে বলেন, করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় যুক্তরাজ্য ছাড়া পুরো ইউরোপ ও অন্যান্য অঞ্চলের ১২টি দেশ থেকে যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
১২টি দেশ হচ্ছে- আর্জেন্টিনা, বাহরাইন, ব্রাজিল, চিলি, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, পেরু, কাতার, সাউথ আফ্রিকা, তুরস্ক, উরুগুয়ে।
তিনি বলেন, ৩ এপ্রিল থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকবে।
তিনি আরও বলেন, যেসব এয়ারলাইন্স এসব দেশ থেকে বাংলাদেশে নিয়মিত যাত্রীবাহী ফ্লাইট পরিচালনা করে, তারা নিষেধাজ্ঞার এই সময়ে কেবল ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার আনতে পারবে। তবে সেক্ষেত্রে ওই যাত্রীদের সেসব দেশে ট্রানজিটের সময় অবশ্যই বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনের মধ্যে থাকতে হবে।
মফিদুর রহমান বলেন, বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের জন্য ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তারা বেবিচক নির্ধারিত প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন সেন্টার অথবা নির্ধারিত হোটেলে থাকবেন। অন্যান্য দেশ থেকে আসা যাত্রীদেরও ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে আগত ও বাংলাদেশ ত্যাগ করবে, প্রত্যেক যাত্রীকে বাধ্যতামূলকভাবে করোনার নেগেটিভ সনদপত্র সাথে রাখতে হবে (যাত্রার ৭২ ঘণ্টা আগে নমুনা দিতে হবে)।
তিনি বলেন, বিমানবন্দর ও ফ্লাইটে সব যাত্রীকে মাস্ক পরতে হবে। এছাড়া যেসব বিমানের প্রতি সারিতে সিট তিনটি করে, সেই ফ্লাইটের মাঝের সিটের যাত্রীকে মাস্কের পাশাপাশি বাধ্যতামূলক ফেসশিল্ড পরতে হবে।
তিনি জানান, সরকারের দেয়া সকল নির্দেশনা ৩০ মার্চ থেকে কার্যকর করা হয়েছে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে।
টেকনাফ-সেন্টমার্টিনের সব পর্যটন জাহাজ চলাচল স্থগিত করা হয়েছে এবং কক্সবাজার ও সিলেটের সকল পর্যটন স্পট বন্ধ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি বজায় রেখে, নিয়মিত যাত্রী এবং প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জিনিস বহনকারী জাহাজগুলির চলাচল স্বাভাবিক থাকবে।
এছাড়া নির্বাচন কমিশন (ইসি) সপ্তাহের শেষ দিকে ১১ এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য সকল নির্বাচন স্থগিত করেছে। জাতীয় ক্রিকেট লীগও মাঝপথে স্থগিত করা হয়েছে।